২৬ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১২:৪৯

ইডিসিএল বগুড়া শাখা

অস্বাভাবিক দরের দরপত্র নিয়ে নানা গুঞ্জন

পোড়া মবিল ২৬০০ টাকা কেজি। নষ্ট টিউবলাইট ৪২০০ টাকা প্রতিপিস। নষ্ট লোহা ৬০০ টাকা কেজি। পুরাতন খবরের কাগজ ৩০০ টাকা কেজি। যেভাবেই হোক টেন্ডারে প্রথম হতে হবে। তাই আকাশ-পাতাল ব্যবধানের অস্বাভাবিক দর প্রদান। পরিকল্পনামতো দর দিয়ে প্রথমও হয়েছেন ঠিকাদার। পিছনের কারণ চুরি। আর ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে গোপনভাবে তৎপর ছিলেন কিছু কর্মকর্তা। এমন একটি অস্বাভাবিক দরের টেন্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড বগুড়া শাখায়।

জানা যায়, প্রতি দুই বছর পরপর এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মালামাল বিক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়।

এতে বিভিন্ন ঠিকাদার দরপত্র দাখিল করে থাকেন। এবার ২০২৩-২০২৪ বছরের জন্য বগুড়া শাখায় প্রথম টেন্ডার নোটিশ প্রকাশ হয় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি। টেন্ডার দাখিল হয় চলতি বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। ওই টেন্ডারে দাখিলকৃত দরপত্রগুলো বাজারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে বাতিল করেন কর্তৃপক্ষ। পরে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেটির দরপত্র দাখিল হয় চলতি বছরের ১২ই এপ্রিল। সেখানে বগুড়ার ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক দর দিয়ে প্রথম হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বিপ্লব (পুরো নাম অনেকেই জানায় বাবুল রানা বিপ্লব আবার বিপ্লব নিজে তার পুরো নাম বলেছেন- খায়রুল আলম বিপ্লব)। তার দাখিলকৃত দরপত্রের দিকে তাকালে চোখ কপালে উঠে যায়। পোড়া মবিল ২৬০০ টাকা কেজি। নষ্ট টিউবলাইট ৪২০০ টাকা প্রতিপিস। নষ্ট লোহা ৬০০ টাকা কেজি। পুরাতন খবরের কাগজ ৩০০ টাকা কেজি। ছেঁড়া কাগজ ৪৮ টাকা কেজি। কাপড়ের পুরাতন ব্যাগ ৬০০ টাকা প্রতি পিস। রাবারের নষ্ট স্যান্ডেল ৩৮৫ টাকা কেজি। বাতিল এসএস নেট ৭১০০ টাকা কেজি। এসি’র পুরাতন পাইপ ৫৮০৩ টাকা কেজি। প্লাস্টিকের জারকিন ৫-১০ লিটার সাইজ প্রতি পিস ৭১৭ টাকা। প্লাস্টিকের জারকিন ২০-৩০ লিটার সাইজ প্রতি পিস ৫০৩ টাকা। প্লাস্টিকের কন্টেইনার ১-৫ লিটার সাইজ ৭১৬ টাকা প্রতিপিস। পিপি পলিথিন প্রতি কেজি ৭০০ টাকা। উল্লিখিত টাকার পরিমাণের সঙ্গে ভ্যাট এবং ট্যাক্স যোগ হয়েছে আরও সাড়ে সতেরো শতাংশ টাকা। এমন অস্বাভাবিক দরে ৪২টি পুরাতন পণ্য ক্রয়ের জন্য বিপ্লব দরপত্র দিয়েছেন এবং প্রথম হয়েছেন। বাজারের সঙ্গে দামের পার্থক্য আকাশ-পাতাল হলেও কেন এমন মূল্যে পুরাতন পণ্য ক্রয় করছেন সেই অনুসন্ধান চালায় এই প্রতিবেদক। টানা এক মাসের অনুসন্ধানে বেরিয় আসে কিছু অনিয়মের তথ্য।

জানা যায়, বিপ্লবের সঙ্গে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড বগুড়া শাখার একজন সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং প্রধান কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাদের পরামর্শে এবং যোগসাজশে বিপ্লব অস্বাভাবিক দর প্রদান করেন। পরে মালামাল বের করার সময় পরিমাণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মাল বের করে পুষিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা হয়। সেই অনুযায়ী বিপ্লব তার প্রথম চালানে অফিসিয়াল হিসাব অনুযায়ী মালামাল বের করেন ২৩২৩ কেজি এবং ৫৫৫ পিস ফাইবার ড্রাম। এই পরিমাণ মালামাল বের করতে একটি ট্রাক যথেষ্ট হলেও তার পছন্দের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তিনি চার ট্রাক মালামাল বের করেন। যদিও অফিসিয়াল-ভাবে ৩ ট্রাক মালামাল বের হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে।

হিসাব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বিপ্লব প্রথম চালানে কার্টন ১৮৯৩ কেজি, ছেঁড়া কাগজ ৪৩০ কেজি, ফাইবার ড্রাম ৫৫৫ পিস। যার মূল্য ৯১,৬০০/- টাকা। ক্রয়কৃত মালামালের ওজন ২৩২৩ কেজি এবং ফাইবার ড্রাম ৫৫৫ পিস যা একটি ট্রাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ঠিকাদার গত ২৫ ও ২৬শে জুন ২ দিনে মোট ৪ গাড়ি বোঝাই করে স্ক্র্যাপের মালামাল নিয়ে যান। অর্থাৎ ২৫শে জুন অফিস সময় বিকাল ৪টার পর এক গাড়ি, পরের দিন ২৬শে জুন দুপুর ১২টায় এক গাড়ি এবং একই দিনে অফিস ছুটির পর সবাই চলে গেলে বিকাল ৫টা ১০ মিনিটে একসঙ্গে আরও ২ গাড়ি বোঝাই করে স্ক্র্যাপের মালামাল গেট দিয়ে বের করে নিয়ে যায়। ওই গাড়ি ২টির ড্রাইভারের নাম মো. নজরুল ইসলাম ও মো. রুহুল আমিন)। এসব গাড়িতে মূলত: কত পরিমাণ এবং কত টাকার স্ক্র্যাপের মালামাল পার করা হয়েছে তার হিসাব বোঝা মুশকিল। তবে সিসিফুটেজ, গেট পাসের তথ্য এবং বিপ্লবের অধীনে মোস্তাক নামের এক লেবার স্ক্র্যাপে কাজ করছেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে এভাবে হিসাব বহির্ভূত মালামাল বের করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভাগ-বাটোয়ারার বিনিময়ে তাকে সহযোগিতা করছেন কিছু কর্মকর্তা। এভাবেই বেশি দামে মাল ক্রয়ের ঘাটতি পুষিয়েও লাভবান হচ্ছে তারা। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিসাধণ হচ্ছে চক্রটির হাতে।

এদিকে চলতি টেন্ডারের আগের বছরের (২০২০-২০২১) টেন্ডারের মূল্য তালিকায় পোড়া মবিলের দাম ছিল ৩৫ টাকা লিটার। এবার সেটি বিপ্লব কিনছেন ২৬০০ টাকা লিটার। ছেঁড়া কাগজের কেজি ছিল ৬ টাকা। এবার বিপ্লব কিনছেন ৪৮ টাকা কেজি। নষ্ট টিউবলাইটের দাম ছিল ১০টাকা এবার সেটি বিপ্লব দাম দিয়েছেন ৪২০০ টাকা প্রতিপিস। পুরাতর খবরের কাগজের দাম ছিল ৩৫ টাকা কেজি। এবার ৩০০ টাকা কেজি কিনছেন বিপ্লব।

কোন উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক দর প্রদান করেছেন জানতে চাইলে বগুড়ার ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব মানবজমিনের এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের জন্য মাথাব্যথা আমার হওয়ার কথা, এ বিষয়ে আপনার মাথা ব্যথা কেন? তিনি পোড়া মবিল রিফাইন করেন। কিন্তু সেই রিফাইন মবিল দিয়ে কি করেন, কত টাকায় বিক্রি করেন কত টাকা লাভ করেন সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি। ২৩২৩ কেজি মালামাল বের করতে চারটি ট্রাক লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেঁড়া কাগজ কার্টন ড্রাম এগুলো জায়গা বেশি লাগে এজন্য এতোগুলো গাড়ি লাগতেই পারে। পরে তিনি সংবাদ পরিবেশন বন্ধের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে এই প্রতিবেদককে অনুরোধ করেছেন।

অস্বাভাবিক দরের টেন্ডার প্রসঙ্গে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের বগুড়া শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মনিরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, কেউ যদি অস্বাভাবিক দরে মালামাল কিনতে চায় সেখানে আমাদের করার কি আছে? অফিসের চোখ ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত মালামাল কেউ বের করতে পারবে না বলে তিনি জানান। ঠিকাদার বিপ্লবের প্রথম চালানের মালামাল কীভাবে কয়টা ট্রাকে বের হয়েছে জানতে চাইলে তিনি ম্যানেজার এডমিন আহাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

পরে বিষয়টি নিয়ে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের বগুড়া শাখার ম্যানেজার এডমিন আহাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বললে তিনি মানবজমিনকে জানান, ঠিকাদার বিপ্লবের প্রথম চালানের মালামাল বের হয় ২৩২৩ কেজি। টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার ৬০০ টাকা। দুইদিনে ৪টি নয়, ৩টি ট্রাক বের হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ওই কর্মকর্তা। ওই ট্রাকগুলোতে বিপ্লবের মালামাল বের হয়েছে। তিনিও অস্বাভাবিক দর দিয়ে স্বাভাবিক বক্তব্য দিয়েছেন, কেউ যদি বেশি দামে মাল ক্রয় করে তাহলে তাদের সেখানে করার কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি বেশি দামে টেন্ডার দিয়েছে সেহেতু তাকে ওই দামেই দুই বছর মালামাল কিনতে হবে। তবে এখানে নয়-ছয় করার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন।

https://mzamin.com/news.php?news=66473