২৫ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:২৩

ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু আগে দেখেনি দেশ

দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এই রোগে মৃতের সংখ্যা পৌঁছল ১৮৫ জনে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে গত বছর সর্বোচ্চ ১৮১ জনের, ২০১৯ সালে ১৬১ জনের এবং ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও অনেক বেশি।

২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন এবং ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এবার গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ২৯৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ২৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ৫৫ জন ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৫ হাজার ২৭০ জনে।
জুলাই মাসের ২৩ দিনেই ভর্তি হয়েছে ২৭ হাজার ২৯২ জন ও মৃত্যু হয়েছে ১৩৮ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে সাত হাজার ৪৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় চার হাজার ৩৯৫ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে তিন হাজার ৬৮ জন ভর্তি রয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি ২০৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে ঢাকার মুগদা হাসপাতালে।

এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮৯ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৯৩ জন, ডিএনসিসি হাসপাতালে ৭৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৫৯ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫২ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৭ জন এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৯ জন ভর্তি হয়েছে।
সপরিবারে অনেকে আক্রান্ত

চার বছরের গোলাম রাব্বি আর ১৯ মাসের হাসান। এই দুই ভাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আটতলার শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসধীন। ওয়ার্ডটিতে শয্যা খালি নেই। মেঝেতে ঠাঁই হয়েছে তাদের।

রাব্বির ক্যানুলা লাগানো হাতে চলছে স্যালাইন, আর হাসান শুয়ে আছে মায়ের কোলে। রাব্বি আর হাসানের মতো অবস্থা আরো অনেকের। সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ওয়ার্ডটির শয্যা সংখ্যার তুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে অনেককেই মেঝেতে রেখে চিকিৎস দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে এই ওয়ার্ডে কথা হয় ওই দুই শিশুর মা রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর সায়েদাবাদের হুজুরবাড়ি লেনের বাসিন্দা। রাবেয়া বেগমের স্বামীও ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালটিতে অবস্থান করছেন।
রাবেয়া বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাব্বিরে শুক্রবার রাতে নিয়া আইছি। ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। রবিবারে হাসানেরও পজিটিভ হইল। রাব্বির প্লাটিলেট আজকে সকালে আইছে ৬২ হাজার। ওগো বাপেরও জ্বর, আজ টেস্ট করতে দিয়া আইছে। বাসায় তালা দিয়া আমরা সবাই এখন হাসপাতালে।’

১২ দিন ধরে একই ওয়ার্ডে রয়েছে রাজধানীর শান্তিবাগের একটি পরিবার। পরিবারের প্রধান জিলানী সরকার (৩৬), তাঁর ভাই জুনায়েদ হোসেন (১৬) ও স্ত্রী ইসরাত জাহান (৩০) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালেই চিকিৎস নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবে শিশু ওয়ার্ডে এখনো জিলানী-ইসরাত দম্পতির ২১ মাস বয়সী সন্তান আবরারের চিকিৎস চলছে।

জিলানী সরকার বলেন, ‘আবরারের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে ১১ তারিখে। তিন দিন শুধু স্যালাইন চলেছে। শরীর লালচে হয়ে গেছিল। আমাদেরও জ্বর ছিল। এর পর থেকে আবরারের সঙ্গে আমরাও হাসপাতালে। আমার ছোট ভাই এই ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল তিন দিন।’
ওয়ার্ডটিতে চিকিৎস চলছিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৩২ শিশুর। এই শিশুদের মধ্যে পাঁচ মাস ১০ দিন বয়সী ফারহানা, ৯ মাস বয়সী ইয়ানার মতো মুমূর্ষু একাধিক রোগী রয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এই শিশুদের সঙ্গে তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভিড়ও রয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎস চলছে এক হাজার ২৫৩ জনের। তাদের মধ্যে ৫৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসর জন্য নির্ধারিত চারটি ওয়ার্ডের অবস্থান হাসপাতালের তিন, আট, দশ ও এগার তলার করিডরে। এ ছাড়া ডেঙ্গু শনাক্তে রক্ত পরীক্ষার জন্য প্রতিদিনই থাকছে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সামনে উপচে পড়া ভিড়।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিদিন ডেঙ্গু শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা দিতে আসে ৭০০-৮০০ জন। রবিবার সকাল ৮টা থেকে আজ (সোমবার) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২০৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। দুজন রোগী মারা গেছে, পাঁচজন রয়েছে আইসিইউতে। রোগীর চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়তি এই চাপ সামাল দিতে আরো চারটি ইউনিট সংযোজনের কাজ চলছে।’
সারা বছর মশা নিধন করতে হবে

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়, সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন পৌরসভায় সারা বছর মশা নিধনের কাজ করতে হবে। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস-৮০ ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন প্রগ্রাম শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।

জাহিদ মালেক আরো বলেন, ‘ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনসহ একাধিক সমস্যার সমন্বিত রূপ ডেঙ্গু জলবায়ু পরিবর্তনের নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। তার মধ্যে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অন্যতম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে জানান তাঁরা। গতকাল রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘পানি স্যানিটেশন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এবং করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/25/1302001