বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। এছাড়াও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হাসপাতালে যাননি, এমন আরো কয়েক লাখ রোগী ছিল। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালকে ছুঁইছুঁই করছে। এরইমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৭৬ জন। আর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন।
বাংলাদেশে চলতি বছর ডেঙ্গু যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা ২০১৯ সালে হয়ে যাওয়া মারাত্মক ডেঙ্গু পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এক সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারা বছর জুড়ে এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু নিযে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দিয়েছে মহামারির ইঙ্গিত। সংস্থাটি বলছে, সারা বিশ্ব পরিস্থিতি মহামারির দিকে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে দেশের ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
আক্রান্তের সংখ্যার হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ২৩শে জুলাই দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৯২ জন। সরকারি হিসাবে এটি এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গুতে একদিনে হাসপাতালে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির রেকর্ড। এবছর এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ।
চলতি বছরের জুন মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮৯০ জন। আর জুলাই মাস শেষ হতে এখনো এক সপ্তাহের মত বাকি আছে, এরইমধ্যে হাসপাতালে ৩১১৬ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। মুগদা হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় বিশেষায়িত চারটি ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। এরপরও হাসপাতালের বেড ফাঁকা নেই। বারান্দায়, মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালটিতে সর্বোচ্চ ৮০০ রোগীর সেবা দিতে পারবেন তারা। এর বেশি হলে হাসপাতালটির পুরো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন রোগ মহামারি হওয়ার জন্য কয়েকটি অবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে কোন রোগ যখন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়, দু’একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যবিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন রোগতত্ত্বের ভাষায় তাকে মহামারি বলে।
তবে রোগতত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করেন তারা একে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবেই উল্লেখ করছেন। জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করা হলে জরুরি তহবিল দেয়া, জরুরি জনবল নিয়োগ করতে হয়, এবং সভা সমাবেশ করা যায় না। বাংলাদেশে এই ঘোষণা না আসলেও জরুরি তহবিল বরাদ্দ করা হয়, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় করা হয়। কাজেই এখানে জরুরি পরিস্থিতি তো হয়েই গেছে। এটা ঘোষণা করার দরকার হয় না।
রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয় যে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ছয়শোর বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান। যদিও এই হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০। ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরতে গিয়ে ডা. নিয়াতুজ্জামান জানিয়েছেন, গত মে মাসে এই হাসপাতালে মোট ৩০৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, দিন দিন রোগীর চাপ বাড়ছে। চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় জনবল বাড়ানো হলেও রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। যে হারে প্রতিদিন রোগী বাড়ছে সে হারে চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছেন ডা. নিয়াতুজ্জামান। আর বাড়তি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হলেও তাকে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
এমন অবস্থায় ডেঙ্গুকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা না গেলে এটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়েও গুরুত্ব দিয়ে এ ধরণের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে আসা দরকার।
ঢাকায় ডিএনসিসির একটি হাসপাতাল রয়েছে সেখানে আটশোর বেশি আসন রয়েছে উল্লেখ করে ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, এটি পরিচালনার যে লোকবল দরকার তা আবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোভিডের পর এই লোকদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল বলে জানানো হয়। বর্তমানে এই হাসপাতালে ১০০-২০০ রোগী ভর্তির সুবিধা রয়েছে।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ডেঙ্গু নিয়ে দিয়েছে কঠিন বার্তা। সংস্থাটি বলছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস আজেপ্তাই জাতীয় মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত। ফলে, গোটা পৃথিবীতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।
হু’র হিসেব অনুযায়ী গতবছর ১২৯টি দেশে মোট প্রায় ৫২ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, প্যারাগুয়েতে ডেঙ্গু ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। করোনার মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু- এমনটাই আশংকা হু’র। তাদের নেগলেক্টেড ডিজিজ কন্ট্রোল বিভাগ জানাচ্ছে- এডিস আজেপ্তাই জাতীয় মশা চরিত্র বদলাচ্ছে। কামড়ের নির্দিষ্ট সময়ও বদলাচ্ছে। তারা জনগণকে অবিলম্বে মশারি ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। মশার আতুরঘর বিনষ্ট করতে বলা হয়েছে। বাড়িতে কোথাও পানি জমা থাকলে তা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।