২৫ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:০৪

আদালতে মামলার জট: বিচার বিভাগ বেসরকারিকরণের সম্ভাব্যতা

ড. মো. নূরুল আমিন

একটা চুটকি দিয়েই আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই। একটি দফতরে হিসাবরক্ষক নিয়োগ করা হবে। বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনজন আবেদনকারী পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে একজন গণিতজ্ঞ, একজন হিসাব শাস্ত্রবিদ এবং অন্যজন অর্থনীতিবিদ। প্রার্থী বাছাই এর জন্য যথারীতি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করা হলো। বোর্ডের একজন আহ্বায়ক এবং দু’জন সদস্য। তারা একজন একজন করে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ-এর জন্য ডাকলেন। প্রথম ডাকা হল গণিতজ্ঞকে। তাকে প্রশ্ন করা হলো: ২ এর সাথে ২ যোগ করলে কত হয়। তিনি ঝটপট উত্তর দিলেন চার। কমিটির আহ্বায়ক তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন এর কোন ব্যতিক্রম কি হয়? গণিতজ্ঞ জবাব দিলেন, না এর কোন সুযোগ নেই। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ডাকা হলো। তিনি হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স। তাকেও একই প্রশ্ন করা হলো, দুই যোগ দুই, সমান কত? তিনি বললেন, সাধারণ নিয়মানুযায়ী চার। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ১০ থেকে ২০ পারসেন্ট কম বেশিও হতে পারে। এখন তৃতীয় ব্যক্তির পালা আসল। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তাকেও একই প্রশ্ন করা হলো। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর না দিয়ে সোজা প্রশ্নকর্তার কাছে চলে গেলেন এবং তাকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার আপনি কত চান? আপনি যা চাইবেন তাই হবে। ইন্টারভিউ শেষ, চাকরি পেলেন অর্থনীতিবিদ। উন্নয়ন প্রকল্পের Cost benefit analysis বা ব্যয় উপকার বিশ্লেষণের বেলায় প্রভাবিত ফলাফলকে নিয়ে আমাদের দেশসহ সারা দুনিয়ায় চুটকিটি বহুল আলোচিত হলেও সাম্প্রতিককালে সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকেই মামলার বিচারে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের রায় প্রদানে নিয়োগ কর্তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিকে এই চুটকির অন্তর্ভুক্ত করছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মি. সিনহার লিখিত একটি পুস্তক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রদত্ত তার কিছু ভিডিও বক্তব্য তাদের এই উদ্যোগকে শাণিত করছে। আমার আলোচনা তা নিয়ে নয়। তবে এ কথা সত্য যে আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ন্যায়ভ্রষ্ট হচ্ছে এবং এ নিয়ে জাতীয় উদ্বেগের সৃষ্টি হচ্ছে। লাখ লাখ মামলার জট সৃষ্টি হচ্ছে, বিচার হচ্ছে না, মানুষের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুকাল আগে সহযোগী দৈনিক প্রথম আলো বিচারালয়ের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির বিকল্প পদ্ধতির সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনটি সহানুভূতিশীল বিবেচনার অবকাশ রাখে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরানুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৪৫,০৭,৮৯৮টি। এর মধ্যে ঐ বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রুজু করা মামলা হচ্ছে ৫৪,৫৪৫টি। মামলার ধরন অনুযায়ী এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৩৯৭,৩৫৪টি দেওয়ানী, ১৯,৬৭,১৬৫টি ফৌজদারী এবং ১৪,৪৩,৩৭৯টি অন্যান্য মামলা। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে জেলা, দায়রা জজ ও অন্যান্য আদালতে আছে যথাক্রমে ২৯,৩৮,৪৪৫টি, হাইকোর্টে ১৪,৬৪,৫৪৫টি এবং আপীল বিভাগে ১৯,৪৯৩টি মামলা। এই তথ্যে মামলার সংখ্যা থাকলেও আসামীর সংখ্যা নেই এবং ফৌজদারী মামলাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মামলাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বলাবাহুল্য, গত ১৫ বছরে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে (ডিসেম্বর পর্যন্ত) ২৩,৯৫৪টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলার আসামী সংখ্যা হচ্ছে তিন লক্ষাধিক। একইভাবে একই সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০০৯৪৩টি এবং আসামী সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৩৩ লাখ। এই তথ্য থেকে পেন্ডিং ফৌজদারী মামলার মোট আসামীর সংখ্যা সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। এই মামলাগুলোর বিচার অস্বাভাবিকভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। আসামীরা মাসে মাসে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে। আসা যাওয়ার খরচ ও উকিল পেশকারের পয়সা দিতে দিতে তাদের সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে। ফলে বিলম্বিত বিচার, বিচার অস্বীকারে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং মানুষ অন্যায় ও অবিচারের শিকার হচ্ছে।
Brac Institute of Governance and Development সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে অমীমাংসিত ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির হার যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে, ১৯৯৪ সালে এই হার ছিল ৫২.১২ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে নিষ্পত্তির এই হার ৫৬.৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৯৭ সালে তা ৪৬.৮৮ শতাংশে হ্রাস পায়। ২০০২ সালে তা ৫০.১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০০৪ সালে ৪০.০০ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৩৭ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৩৪.০০ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৩২.০০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৩৫.০২ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে তা আরো কমে ৩৫.০০ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই খাতের অগ্রগতি পাওয়া যায়নি।

বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ২০০৭ সাল পর্যন্ত অধস্তন বিচারক পদে নিযুক্ত ছিলেন প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেটরা। ২০০৭ সালের পর ফৌজদারী বিচার বিভাগ পৃথক করা হয় এবং ২০০৮ সাল থেকে হাইকোর্টের নিযুুক্ত বিচারকরা ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করেন। আগে অভিযোগ ছিল নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচার কাজকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন না এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায় না। আশা করা গিয়েছিল যে, ফৌজদারী আদালতে হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন বিচারক নিয়োগ করার পর মামলার নিরপেক্ষ নিষ্পত্তির হার বেড়ে যাবে এবং মানুষ সুবিচার পাবে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হারের যে তথ্য তা উপরোক্ত ধারণাকে সমর্থন করে না। এছাড়া অভিযোগ উঠেছে যে বর্তমানে মামলা নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া, জামিন ও রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রভাব প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

অনুরূপভাবে অধস্তন আদালত কর্তৃক দেওয়ানী মামলার নিষ্পত্তি হারও হতাশাব্যঞ্জক। একই সূত্রানুযায়ী ১৯৯৯ সালে এই হার ছিল ২৬.৭৬%, ২০০০ সালে ২৮.৩৫%, ২০০২ সালে ২৭.১৩%, ২০০৭ সালে ২৫%, ২০০৮ সালে ১৮%, ২০০৯ সালে ২০%, ২০১১ সালে ৬%, ২০১২ সালে ৬.০২%, ২০১৩ সালে ১৮ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২২ শতাংশ। এতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর দেওয়ানী আদালতের কার্যক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। অবিলম্বে এর কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের মামলা নিষ্পত্তির হারও সন্তোষজনক নয়। ব্রাক ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আপীল বিভাগে দরখাস্ত নিষ্পত্তির হার ৩.২৮%, আপীল নিষ্পত্তির হার ৮.৪৩%, হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারী আপীল নিষ্পত্তির হার ৯.৫২%, হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তির হার ১৯.৯৬%, হাইকোর্ট বিভাগের রীট আবেদন নিষ্পত্তির হার ৮.২৩% এবং হাইকোর্ট বিভাগের দায়েরকৃত অরজিনাল মামলা নিষ্পত্তির হার ৯.৩৩ শতাংশ। আমি এখানে ১০ বছরের গড় উল্লেখ করেছি বিস্তারিত অবস্থা আরো খারাপ। গত ১০ বছরের দেওয়ানী আপীলের নিষ্পত্তির হার থেকে দেখা যায় দায়েরকৃত আপীলের মাত্র ৫.০০৯% আপীল বছরে নিষ্পত্তি হয়। এই হারের তাৎপর্য হলো কেউ হাইকোর্টে দেওয়ানী আপীল করলে ফলাফল পাবার জন্য তাকে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এরপর যদি আপীল বিভাগে আপীল করা হয় তাহলে আরো ৮.০৪৩ বছর তাকে অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ জেলা জজ আদালতে যদি একটি দেওয়ানী মামলা রুজু হয়, তবে জেলা আদালতে প্রায় ৫ বছর এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগে আপীল নিষ্পত্তি করতে আরো ২৮ বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ বিচার পাবার জন্য আপনাকে ৩৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের শ্লথ নিষ্পত্তির হার মানুষের শুধু অধিকারই হরণ করেনা সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়।
বিচার ব্যবস্থার পৃথকীকরণ এক্ষেত্রে সুফল আনেনি। বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে বিবেচ্য হতে পারে। তবে আমার মনে হয় বিচার ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি ফলপ্রসূ বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে। কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় সারা দুনিয়ায় সরকারের আকার ছোট করে দুনিয়াব্যাপী বহু সরকারি সেবা বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের পরিবর্তে এনিজওগুলো দক্ষতার সাথে এর আঞ্জাম দিচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের পাশাপাশি শতশত বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বিচার বিভাগকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়া কঠিন কাজ।

তবে পাইলট ভিত্তিতে সুপ্রীমকোর্টের নিয়ন্ত্রণে কিছু উঁচুমানের কিছু বেসরকারি আদালত প্রতিষ্ঠা করে পরীক্ষামূলকভাবে এই কাজ শুরু করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। এই আদালতের বিচারকরা হবেন চরিত্রবান ও নিরপেক্ষ। তা না হলে মামলার যে জট সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হতে থাকবে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এবং মানুষের জীবিতাবস্থায় তাদের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভবপর নয়।

বৃটিশ আমলে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও জুরি সিস্টেম চালু ছিল। আদালত শিক্ষাদীক্ষা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও নিরপেক্ষতা বিচার করে জুরি নিয়োগ করতেন এবং তারা মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে আদালতকে সহযোগিতা করতেন। আফ্রিকার অনেক মুসলিম দেশে বিচারকরা অকুস্থলে গিয়ে মামলার শুনানি গ্রহণ করেন। তারা বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষ, সাক্ষী এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি মসজিদের ইমামদের সাথেও পরামর্শ করেন এবং তাৎক্ষণিক মামলার নিষ্পত্তি করেন। আমাদের দেশে এ ধরনের পদ্ধতি এক সময় চালু ছিল। তাকে কাজীর বিচার বলা হতো। এখনো বাংলাদেশের অনেক প্রাচীন মসজিদে কাজী বা বিচারকদের বিচারাসন সংরক্ষিত রাখা আছে। যেমন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ। বৃটিশ আমলে বিচার কাজের সাথে উকিল মোকতারদের সম্পৃক্ত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এদের সম্পৃক্তি বিলম্বিত বিচারের অন্যতম প্রধান কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়া দরকার এবং মিথ্যা প্রতিহিংসামূলক গায়েবী রাজনৈতিক মামলাগুলো আগামী নির্বাচনের আগেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেয়া হলে মামলার জট অনেক কমে যেতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

https://dailysangram.info/post/530847