২৪ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১:০০

ডেঙ্গুর থাবা ৬৩ জেলায়

ডেঙ্গুর ১১টি রেড জোন ঢাকায়। ৬৩ জেলায় এখন ডেঙ্গুর থাবা। বাদ শুধু চুয়াডাঙ্গা। ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে পরিস্থিতি। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে রোগী সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মিনিটে মিনিটে রোগী আসছেন হাসপাতালে। একদিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৯২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রাণ গেছে ৯ জনের। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।

শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ রোগীর ঠাঁই হয়েছে ঢামেক হাসপাতালের মেঝেতেই। ফ্লোর, বারান্দা, সিঁড়ি, করিডোরসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বেড পেতে স্থান নিয়েছে ডেঙ্গু রোগী। চিকিৎসায় যথেষ্ট প্রস্তুতির ঘাটতি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বাইরে প্রস্তুতি নেই বললেই চলে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয় দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড) অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গুতে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেভাবে গ্রামে বা শহরে প্রস্তুতি নেই। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এজন্যই দিন দিন সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। হাসপাতালে লোকবল নেই, বেড নেই। অনেক হাসপাতালেই রোগীকে মশারিও দেয়া হয় না। তিনি দ্রুতই ডেঙ্গু মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোকে ভালোভাবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে মশা মারার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই ভাইরোলজিস্ট। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় ঝালকাঠি জেলার সিভিল সার্জন ডা. এইচএম জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। গতকাল তিনি মানবজমিনকে জানান, ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। তার জেলায় ১০০-এর উপরে রোগী আছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এই বিষয়ে তাদের সব প্রস্তুতি আছে। আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে। আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়া সব চিকিৎসা দেয়া যাবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

ঢামেক ৬০১ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে ফ্লোরে সিঁডির কাছে অবস্থান নেয়া ডেঙ্গু রোগী জয় জানান, বড় আশা করে মাদারীপুর থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তার জেলায় চিকিৎসায় ভরসা না পেয়ে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসার আশায় ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু আশানুরূপ চিকিৎসা পাননি তিনি। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার আগে তিনি ঢাকার চকবাজারে এসেছিলেন। তার ধারণা চকবাজার থেকেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি জানান, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ও চোখ জ্বালাপোড়া নিয়ে হাসপাতালে আসেন।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যেসব জায়গা থেকে বেশি ডেঙ্গু রোগী আসছেন, এরমধ্যে আছে যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, ধানমণ্ডি ও বাসাবো। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জায়গাগুলোর মধ্যে আছে উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও ও বাড্ডা।

ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ ২২৯২ হাসপাতালে ভর্তি: মিনিটে মিনিটে রোগী আসছে হাসপাতালে। হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জুলাই মাসের ২৩ দিনে ১২৯ জনের মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ২৪ হাজার ৯৯৯ জনে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৬ জনে। এরমধ্যে নারী ১০১ জন এবং পুরুষ ৭৫ জন মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৩৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক ২ হাজার ২৯২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ২৯২ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ২২৮ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ২৯২ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৭৫ জনে।

ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ হাজার ১৪৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ২৬ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৩২ হাজার ৯৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ২০ হাজার ৮৯৬ জন এবং নারী ১২ হাজার ৮১ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ হাজার ৬২৬ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাই মাসে শনাক্ত ২৪ হাজার ৯৯৯ জন এবং মারা গেছেন ১২৯ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই: ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদি বিপদচিহ্ন থাকে তবে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। বিপদচিহ্ন উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলে, পেটে ব্যথা, অত্যাধিক পানি পিপাসা থাকা, ঘনঘন বমি বা বমি বন্ধ না হওয়া, রক্ত বমি বা কালো পায়খানা হওয়া। অনেক রোগীর দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হয়, কারও কারও ছয় ঘণ্টার বেশি সময় প্রস্রাব না হলে তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। এ ছাড়া প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও অত্যাধিক শারীরিক দুর্বলতা অনুভব, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে গেলে হাসপাতালে যেতে হবে। এ ছাড়া গর্ভবতী ও শিশু, ডায়াবেটিস ও দুরারোগ্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বিপদচিহ্ন ছাড়া বাকিরা বাড়ি থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবে। বিশেষ করে যেসব ডেঙ্গু রোগী মুখে পর্যাপ্ত তরল খাবার খেতে পারে, প্রতি ছয় ঘণ্টায় প্রস্রাব হয় এমন রোগী বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবে। তবে বাড়িতে থাকলেও তাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ সময় তাদের পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত লবণযুক্ত তরল যেমন: স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি পান করতে হবে। ওষুধের ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডেঙ্গুতে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। পূর্ণ বয়স্কদের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিগ্রামের ৬টি ট্যাবলেট এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।

জ্বর কমাতে কুসুম গরম পানিতে সরাসরি শরীর মুছে ফেলতে হবে। এতে ভালো প্রতিকার পাওয়া যায়। ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাসা বাড়িতে জমানো পানি তিন দিনের বেশি রাখা যাবে না। দিনে-রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানাতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ছোট-বড় সবাই সর্বোচ্চ শরীর ডেকে রাখে এমন কাপড় পরতে হবে। বর্তমানে রোগীর জ্বর থাকলে ডেঙ্গু পরীক্ষা এনএস-১ করাতে হবে। চিকিৎসা গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=66150