২৪ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৭

বর্তমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা যাচাই ছাড়াও যেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে দলটি

মুহাম্মদ নূরে আলম: বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে তৎপরতা বাড়িয়েছে ইইউ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের-ইইউ প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের বহুল আলোচিত সফর শেষে গতকাল রোববার ঢাকা ছেড়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর বাকি কয়েক মাস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে হবে এ নির্বাচন। এ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে যতটা উত্তাপ ছড়িয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে বিদেশী তৎপরতা। আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হয় সেই চাপ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে। ঘন ঘন দেশটির প্রতিনিধিদল সফর করছে। পিছিয়ে নেই ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)। ঢাকা ছাড়ার আগে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় ১০০টির মতো বৈঠক করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এইসব বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন তারা। এসব আলোচনায় নির্বাচনের সময় সহিংসতা, বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন তারা। এ সফরে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছে তারা। তবে আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না এখনো ইইউ প্রতিনিধিদল এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব কিনা তা বোঝার চেষ্টা করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে জানান, শুধু সরকারি দল ছাড়া প্রত্যেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে বোঝা যাবে দেশের প্রকৃত চিত্র।

সর্বশেষ, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আসেননি তারা। প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটি আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে নির্বাচন বিষয়ে মতবিনিময় করে। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেলের কাছে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেবেন তারা। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল আসবে কিনা। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে জানতে ৮ জুলাই ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছে ছিল ইইউ অনুসন্ধানী দল। ২৩ জুলাই পর্যন্ত সফরের শিডিউল করা এ প্রতিনিধিদলে আছেন দিমিত্র ইওয়ানু, আলভেস ক্রিটিনা ডস রামোস, মিলার ইয়ান জেমস, শ্যামেন ক্রিস্টোফার ও ম্যারি-হেলেন এন্ডারলিন প্রমুখ।

ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সফরকালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেছেন। সে সময় তারা নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচনের সময় সহিংসতা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, ভোটার তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে কীভাবে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়, তারা সে উত্তর খুঁজেছেন।
ইইউ প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বিধায়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি।

ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকা সফরকালে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন, এ নিয়ে জানতে চান ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

সফরকালে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। নির্বাচনকালে তারা কি কি সমস্যায় পড়েন সেসব বিষয়ে জানতে চান ইইউ প্রতিনিধিরা। এ সময় নিজ নিজ প্রতিনিধিরা নির্বাচনকালে তাদের সমস্যা তুলে ধরেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে শান্তি বজায় রাখবে সে জবাবও খুঁজেছেন তারা। এছাড়া বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সে বিষয়েও অনুসন্ধান করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
ইইউ প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলটির সফর ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঢাকার বাইরে সিলেটে গিয়েও প্রতিনিধি দল সফর করে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৬ সপ্তাহের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সফর করতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ সময় তারা পার্বত্য এলাকার নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবে। ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি সরকারের কাছে এই প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইইউ'কে এখনো জানানো হয়নি। ইইউ প্রতিনিধি দল ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ব্রাসেলসের ইইউ অফিসে পেশ করবে। তবে আগামী নির্বাচনে প্রতিনিধি দল পাঠাবে কি না, সে বিষয়ে ব্রাসেলস অফিস চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের জন্য একটি অফিস খুঁজছে ঢাকার ইইউ অফিস। ব্রাসেলস থেকে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত এলে দ্রুত যেন অফিস নেওয়া যায়, সে জন্য আগেভাগেই অফিস খোঁজা হচ্ছে। উল্লেখ্য, রিকার্ডো চেলেরির নেতৃত্বে ৬ সদস্যের ইইউ প্রতিনিধি দল গত ৯ জুলাই ঢাকায় আসেন। তবে প্রতিনিধিদলের নেতা রিকার্ডো চেলেরিসহ দু'জন সদস্য ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে ফিরে যান। পরবর্তীতে বাকী ৪ সদস্য ঢাকায় অবস্থান করেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, প্রতিনিধি দল সে বিষয়ে সুপারিশ করবে। তাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই ইইউ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

এছাড়া ইইউ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও সঠিক করার কথা বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, দেশের অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক কি না তারা জানতে চেয়েছেন। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমি কোনো প্রস্তাব দেইনি। বলেছি, মানুষের বিকল্প বেছে নেয়ার স্বাধীনতা যেন থাকে, পুরো প্রক্রিয়াটা যেন স্বচ্ছ হয়, কোনো রকম কারসাজি যেন না হয় তা নিশ্চিতের বিষয়ে বলেছি।

সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন। এ সময় তিনি শেষ দুই নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। বৈঠক শেষে বের হয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু সরকারি দল ছাড়া প্রত্যেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে বোঝা যাবে দেশের প্রকৃত চিত্র। এছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গণমাধ্যমকে বলেন, ইইউর এ দলটি প্রাথমিক পর্যায়ের, এরপর আরও দুটি দল আসবে। তবে প্রাথমিক দলটি আসন্ন ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তোষজনক প্রতিবেদন দিলেই পরবর্তী এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণে চূড়ান্ত মিশন পাঠাবে ইইউ। ইইউর নির্বাচনি পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত এ মিশনগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে তারা পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০০৭-৮ সালের ভোটে ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনে মোট ১৪০ জন সদস্য ছিল। বাংলাদেশের ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের দুই পক্ষের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে ইইউর বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তা প্রভাব ফেলবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক দিনের সফরে ইইউ প্রতিনিধিদল সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে তারা আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছে। এর মধ্যে গত ১৫ জুলাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, সংসদের বাইরে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এবি পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলো এ সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার পক্ষে মত দিয়েছে এবং তাদের যুক্তি তুলে ধরেছে। এ সরকারের অধীনে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে না এবং সহিংসতার আশঙ্কা করে দলগুলো ইইউ প্রতিনিধিদলকে অনুরোধ জানিয়েছে, নির্বাচনে যেন ইইউ পর্যবেক্ষক দল না পাঠায়।

https://dailysangram.info/post/530769