২৪ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১২:৩৯

স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সঙ্কট

এডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন

নিবন্ধের শিরোনামটি আমার নয়! একটি জাতীয় দৈনিক থেকে ধার করে নেয়া। এ শিরোনাম কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু সম্প্রতি এসডিজি (SDGs) অর্জনে ১৭টি লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতির আলোকে বিশ্বব্যাংক ‘‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০২৩ শিরোনামে’’ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এসডিজি হলো বিশ্বমানবতার সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত একটি কর্মপরিকল্পনা। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষ যেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্রয় করতে পারে সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারকে (এসডিজি) দ্বিতীয় লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। যেসব দেশ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারে না তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না। অর্থাৎ তাদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্রয় করার সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশের সর্বশেষ যে জনশুমারি হয়ে গেল তার রিপোর্ট অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। অর্থাৎ বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারছেন না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এমনটিই উঠে এসেছে। অথচ উন্নয়নের গালভরা গল্প বেশুমার। কিন্তু উন্নয়নের সুফল সমভাবে প্রভাব ফেলছে না। বিগত ১৫ বছরে কারা অর্থবিত্তের মালিক, কারা সম্পদশালী, কারা শূন্য থেকে কোটিপতি, সে তালিকা জাতির সামনে উন্মোচন করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।

একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ পুষ্টির চাহিদা মত পর্যাপ্ত খাবার খেতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং খর্বকায় হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ২০০০-২০১৫ সালে ১৫ বছর মেয়াদি সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে যা এমডিজি নামে পরিচিত। তারই ধারাহিকতায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ১৫ বছর মেয়াদি আরো একটি লক্ষ্যমাত্রার পরিকল্পনা হাতে নেয় যার উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য একটি ভালো ও টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনের কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন। সে লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যে ১৭টি এসডিজি হলো ঃ ১. দারিদ্র্য বিমোচন; ২. ক্ষুধা মুক্তি; ৩. সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ; ৪. মানসম্মত শিক্ষা; ৫. লিঙ্গ সমতা; ৬. নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন; ৭. সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি; ৮. শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; ৯. শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো; ১০. বৈষম্য হ্রাস; ১১. টেকসই নগর ও জনপদ; ১২. পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন; ১৩. জলবায়ু কার্যক্রম; ১৪. জলজ জীবন; ১৫. স্থলজ জীবন; ১৬. শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান; ১৭. অভীষ্ট অর্জনের অংশীদারিত্ব। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশে^র সব মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দ্বিতীয় দফার ক্ষুধামুক্তির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যে চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ এ চিত্রের মাধ্যমে বহু দেশের স¦াস্থ্যসম্মত খাবারের চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে বাংলাদেশের মতো মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ খাবার কিনতে পারছে না এমন খবর চোখে পড়েনি। চারদিকে শুধু উন্নয়নের গল্প। কিন্তু উন্নয়নের গল্পের সাথে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন জুতসই নয়। বাজারে গেলে টের পাওয়া যায় কত ধানে কত চাল। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আদা, চিনি, মসলা থেকে শুরু করে সবজির দাম শুনলেই বুকের ভেতর ধড়ফড় করে। কারণ আয় বাড়েনি, পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। কাটছাঁট করেও কুলিয়ে উঠা যাচ্ছে না। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে- চিনির দাম বেশি চিনি খাওয়া বাদ, ডালের দাম বেশি ডাল খাওয়া বাদ, কাঁচা মরিচের দাম বেশি কাঁচা মরিচ খাওয়া বাদ, বাচ্চার দুধের দাম বেশি দুধ খাওয়া বাদ, চালের দাম বেশি চিকন চাল খাওয়া বাদ, মুরগির দাম বেশি মুরগি খাওয়া বাদ। কিন্তু বাচ্চার স্কুলের ফি ও খাতা-কলম বাদ দিতে পারছেন না। ফলে বেশিরভাগ অভিভাবকের মাথায় হাত। সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার সীমার বাইরে চলে যাওয়ায় অনেকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে উন্নয়নের স্লোগান হালে পানি পাচ্ছে না। যে উন্নয়ন তৃষ্ণার্ত মানুষের ক্ষুধা ও মুখে হাসি ফুটাতে পারে না সে উন্নয়ন কারও জন্য সুখকর হয় না।

সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং সানেমের জরিপ বেশ আলোচিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির জরিপে বলা হয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নি¤œআয়ের পরিবার ধারা-দেনা করে চলছে। গত ছয় মাসে এসব পরিবারের ব্যয় প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশ পরিবার জরিপে অংশ নিয়েছেন। অর্থনৈতিক চাপে খাবারের খরচ কাটছাঁট করেও তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, এমনটিই জানিয়েছেন। ৯৬ শতাংশ পরিবার গোশত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আগে যারা মাসে চারবার মুরগির গোশত খেতেন তারা এখন দুবার মুরগির গোশত খেতে পারছেন না। ৮৮ শতাংশ পরিবার মাছ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম এবং ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ১৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার সানেমকে জানিয়েছেন, এরকম পরিস্থিতি চলমান থাকলে খাবার সংগ্রহ করার জন্য জমি বিক্রি করা ব্যতীত আর কোন উপায় থাকবে না। ১৯ শতাংশ পরিবার শিশুদের কাজে নিযুক্ত করার কথা জানিয়েছেন। ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়া না থামলে তারা ব্যয় কমানোর জন্য সন্তানদের পড়াশুনা বন্ধ করে দেবেন। এমনকি অনেকে ব্যয়ের চাপে কন্যা সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ২৫ শতাংশ পরিবার মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠা বড্ড কঠিন। (সূত্র ইত্তেফাক, ৩০ মার্চ ২০২৩) ধনী-গরিবের মধ্যে আয়-সম্পদ-শিক্ষা-চিকিৎসার বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামাজিক অন্যায় অবিচার জুলুম বেড়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় খুনাখুনি বেড়েছে। আয়-বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অতিদরিদ্র মানুষ যেখানে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছে না সেখানে গত ১৪ বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে, এটা আমার কথা নয়! বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমনটি উঠে এসেছে। গত ১৪ বছরের (২০০৯-২০২৩ মার্চ) কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ৯২ হাজার বেড়েছে, যা শতকরা হিসাবে প্রায় পাঁচগুণ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যেখানে ১৯ হাজার ছিল সেখানে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৭ জন। আর গত তিন মাসে এ সংখ্যা ২৪৫ জন বেড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ জন হয়েছে।

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে আজোও পণ্যের দাম বাড়িয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের পকেট ভারি করার সকল আয়োজন অব্যাহত রাখছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ মূল্যস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে তাদের আয় বাড়ছে না। অথচ বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ছেলে ভোলানো গল্প কাহিনী শোনানো হয়। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় না। কাঁচা মরিচের দাম হাজার পার হয়ে যায়। দায় কেউ নেয় না। কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক দাম বাড়া নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন,‘ঝড়-বৃষ্টিতে যদি কাঁচা মরিচ পচে যায়, তাহলে আমি কী করব? আসলে তো তাই! কাঁচামরিচ পচে গেলে মন্ত্রীমহোদয় কী করবেন? এরকম দায়সারা কথা যখন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখ থেকে শুনি তখন হৃদয়ে দাগ কাটে। ভোক্তা অধিকার আছে। মাঝে-মধ্যে কিছু দোকানদের জেল-জরিমানা করার দৃশ্য দেখা যায়। ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়। ওই পর্যন্তই শেষ! প্রতি সপ্তাহে পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। কিন্তু প্রতিরোধ সেভাবে হয় না। ফলে পণ্যের স্বাভাবিক দাম বিরাজ করছে না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে চরম বৈষম্যও বাড়ছে। উন্নয়নের সুফল শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের কপালে জুটছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে ২০৩০ সালর মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা প্রয়োজন। যেন সবার ভাগ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত হয়।

https://dailysangram.info/post/530743