২২ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:১৪

কর্মক্ষমরাই বেশি আক্রান্ত ডেঙ্গুতে

২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ৮৯৬, মৃত্যু ২

কর্মক্ষমরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। এ প্রবণতা দেশের সর্বত্র তবে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি। গুরুতর অসুস্থ না হলে ডেঙ্গুতে সপ্তাহের মধ্যে সেরে উঠলেও পরবর্তীতে দুর্বলতা থাকে অনেক দিন। আক্রান্তরা অনেকদিন শারীরিক দুর্বলতায় ভোগে বলে পরিশ্রম করতে পারে না। ফলে দিন আনে দিন খায় অথবা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যারা রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে অনেকদিন তাদের অর্থনৈতিক ভোগান্তিও পোহাতে হয়।

খিলগাঁও এলাকার এমন একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত গতকাল শুক্রবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছিলেন। তিনি পথচারীদের কাকুতি-মিনতি করে বলছিলেন, ‘আমি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। আমি একজন নির্মাণ শ্রমিক ছিলাম। কাজ করার মতো শক্তি নেই শরীরে। আমাকে কিছু সাহায্য করেন।’ ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী এই লোকটির শরীরে কোনো চর্বি নেই। উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির মতো হলেও তার শরীরের ওজন ৫০ কেজির বেশি হবে না। এই লোকটির স্বাভাবিক ওজন হওয়ার কথা ছিল ৬৮ থেকে ৭২ কেজির মধ্যে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার কিছু অংশ বিনামূল্যে পেলেও বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হয় বলে ডেঙ্গু আক্রান্তরা পড়ে যায় দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্রে। এর মধ্যে রক্তের প্লাটিলেট আলাদা করে দেয়া একটি কাজ। চিকিৎসকরা বলছেন, চার ব্যাগ রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসার ৬৪ শতাংশই (কোনো কোনো সংস্থা এখন ৭০ শতাংশ বলছে) নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। ফলে এদেশে চিকিৎসা করাতে বছরে ৫০ লাখের বেশি মানুষ স্বচ্ছল অবস্থা থেকে দরিদ্র হয়ে যায়। বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের একই অবস্থা চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুসারে ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বেশি। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, শনিরআখরা, সায়েদাবাদ, মুগদা, সবুজবাগ, বাসাবো, কদমতলা, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের এলাকায় বসবাসকারী, মিরপুরের নিচু এলাকার মতো অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পুরুষেরা। অন্যদিকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। এই বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম।

এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম মোজাহেরুল হক বলেন, ‘কোনো দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম। এই শ্রেণীর লোকজন বেশি রোগাক্রান্ত হলে এটা দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তথা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কাজ করতে না পারলে জাতীয়ভাবে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। আবার নিম্ন আয়ের লোকজন হলে পরিবারটি অনেক আর্থিক অনটনে ভোগবে। ফলে পরিবারের নারী ও শিশুদের পুষ্টি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে এবং তাদের শিশুরা অপুষ্ট হয়ে বড় হবে।’ অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গু এখন দুর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারের উচিত এটাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া এবং ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নির্মূলে বিশেষ অভিযান চালানো।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে দেখা গেছে, গত জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দেশে মোট ২৮ হাজার ৪৪৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ঢাকা শহরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ১৭ হাজার ৬৪৬ জন। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১৮ থেকে ৪০ বছরের বয়সীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৮ হাজার ৫২০ জন। ঢাকার বাইরে সারা দেশের হাসপাতালে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৮০৭ জন। ঢাকা শহরে ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৯৬ জন এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ৯০৭ জন। এক বছরের কম বয়স থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে ঢাকা ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ৩৪। ঢাকার বাইরে এই বয়সীদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৬৪। সারা দেশে এক বছরের কম বয়স থেকে ১০ বছর বয়সী মোট আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ৮৫৮। এছাড়া কেবল ৫ বছরর কম বয়সীদের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৫০৪ এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৩৬৩।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জিন্সি অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গতকাল সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৯৬ জন। সরকারি ছুটির ছিল বলে অনেক হাসপাতাল গতকালকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরকে দেয়নি। সে কারণে ডেঙ্গুর এই ভরা সংক্রমণের দিনেও হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা কম ছিল। এ ছাড়া গতকাল মারা গেছে একজন। হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪০৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৯৩ জন।

ফরিদপুরে ১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৫২

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ওই রোগীর নাম জাহানারা বেগম (৩৯)। তিনি রাজবাড়ী জেলা সদরের দাদশী ইউনিয়নের আগমরী গ্রামের মো: ইউনুসের স্ত্রী।

শুক্রবার ভোরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় জাহানারা বেগমকে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: এনামুল হক জানান, গতকাল শুক্রবার ভোরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাহানারা নামে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। তিনি বৃহস্পতিবার রাতে রাজবাড়ী থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছরে এই প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুরে একজন মারা গেলেন বলে তিনি জানান।

এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫২ জন ডেঙ্গু রোগী ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৬৩ জন রোগী। অন্য দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৩১ জন।

জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এখন পর্যন্ত ৫০৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন ৩৪৫ জন। আর গতকাল শুক্রবার এই প্রথম একজন মারা গেলেন। অন্য দিকে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০২ জন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/764093