২২ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:১১

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বাতিলের পর অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে সূচিত হয় ‘কালো অধ্যায়’

ভোটারবিহীন নির্বাচনে ছিল না জনমতের তোয়াক্কা

দেশে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ বাতিলের পর প্রথম অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতিতে এক ‘কালো অধ্যায়’ সূচিত হয়। একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গিয়ে গ্রহণ করা হয় পোড়ামাটি নীতি। ভোটারবিহীন নির্বাচনে ছিল না জনমতের কোনো তোয়াক্কা। নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপব্যবহারের নয়া রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ফিরে দেখা সেই সময়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে মূলত দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা হয়। এর ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হবার সুযোগ পায়। প্রসঙ্গত, দেশের শীর্ষ আইনজ্ঞদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করে আসছিলেন। এর মধ্যে হাইকোর্টের তিন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতার পক্ষে রায় দেন। আবার আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৪ জন এর বিপক্ষে রায় দেন এবং দু’জন পক্ষে ও একজন কোন পক্ষেই মত না দিয়ে বিষয়টি সংসদের উপরে ছেড়ে দেন। যোগফলে দেখা যায়, দুই কোর্টের ১০ বিচারপতির মধ্যে ৫ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতার পক্ষে, চারজন বিপক্ষে ও একজন মাঝামাঝি অবস্থান নেন। আর, আপিল বিভাগে শুনানির সময় আদালতের পক্ষ থেকে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবীকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে ৭ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি শুনানিকালে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন।

অনৈতিকতা আর শঠতার ছড়াছড়ি: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনের রেকর্ড সৃষ্টিকারী, চরম বিতর্কিত, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতের বিরুদ্ধে এবং দেশ-বিদেশে প্রবল নিন্দা কুড়ানোর একটি আয়োজন ছিল বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন। যে কোন আড্ডায়-জটলায় সর্বস্তরের মানুষের ভেতরে একই আলোচনা ছিলÑ নির্বাচনের নামে কেবল ‘শঠতা ও অনৈতিকতা’র অনুশীলন হয়েছিল মাত্র। এর মধ্য দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপমৃত্যু ঘটানো হয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার নামে প্রহসনের এক নয়া বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এছাড়া অতীতের নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনে প্রার্থীর বিপুল সংকট দেখা যায়। বিরোধীদের হাত-পা বেঁধে একতরফা নির্বাচন আয়োজন করার উদাহরণ তৈরি হয়। এই প্রথম একটি জাতীয় নির্বাচনে শীর্ষ নেতাদের প্রায় কারোরই ভোট দেবার সুযোগ হয়নি। জাতীয় পার্টি ও এরশাদকে নিয়ে

এক চরম অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে দেখা যায়। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের নয়া রেকর্ডও স্থাপিত হয়। নির্বাচনে ভোটারের কোন প্রয়োজন না হওয়ায় জনমতেরও কোন তোয়াক্কা করার দরকার পড়েনি।

কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা: সেই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, সর্বনি¤œ ভোটার উপস্থিতি, জাল ভোটের মহোৎসব ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো পূরণ করা, একেকজন শত শত ভোট দিয়ে উল্লাস প্রকাশ, সর্বাধিক সংখ্যক কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়া, বহু সংখ্যক প্রার্থীর ভোট বয়কটের ঘোষণা দেয়া প্রভৃতি ঘটনা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করে। অন্তত ৪১টি কেন্দ্রে আদৌ কোন ভোট পড়েনি- এমন ঘটনাও ঘটে। আবার বেলা ১টার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট কাস্টিং হলেও বিকেল ৪টায় তা হয়ে যায় ৭০ ভাগের ওপরে। অনেক স্থানে পুরো একটি পরিবারের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়। বিভিন্ন কারণে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৫শ’ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে হয়। তিনশ’ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও কম আসনে ভোট করতে গিয়েও এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ এনে ভোট গ্রহণের দিনে অন্তত ২০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাঁদের মধ্যে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি, জাসদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানীর ঘটনাও একটি রেকর্ড। শুধু নির্বাচনের দিনই ২১ জনের মতো লোক নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা ঘটে তা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখেননি দেশবাসী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৫ নবেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ লোকের প্রাণহানী ঘটে। ব্যয়ের দিক থেকেও রেকর্ড গড়ে এই নির্বাচন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয় ১৬৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর আগের নির্বাচনগুলোর ব্যয় ছিল আরো অনেক কম। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যয় ২৯১ কোটি টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড : এবারের নির্বাচনকে কোনো কোনো ভাষ্যকার ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তামাশা’ বলে আখ্যায়িত করেন। কোন নির্বাচন ছাড়াই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দেয়া হয় প্রার্থীদের। এসব আসনে কাউকে ভোট দেয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে হয়নি। বাকি ১৪৭ আসনে কেবল নির্বাচনের মহড়া দেয়া হয় ৫ জানুয়ারি। এগুলো শুধু তাদের জোটের শরীকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। একজন বিশ্লেষকের মতে, একদিকে ১৫৩টি আসনের জন্য ৪ কোটি ৬৮ লক্ষ ৬৯ হাজার ভোটারকে ভোট দেয়া তো দূরের কথা, ভোট কেন্দ্রে যেতেও হয়নি। আর বাকি ১৪৩টিতে ভোটের নামে কী করা হয় দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করে। এই নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যাও ছিল ইতিহাসের সর্বনি¤œতম। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ও ১৪৭টি আসনের প্রার্থীসহ মোট প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮৬ জন।

ইসিকে অপব্যবহারের রেকর্ড: তত্ত্বাবধায়ক-পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহারের ক্ষেত্রেও এক নয়া রেকর্ডও স্থাপিত হয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগ উঠে, বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচনে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নমুনা হচ্ছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দেয়া, আ’লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির তৎকালীন কো-চেয়ারম্যানের ‘বেআইনি’ চিঠিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন বেশ কিছু আসনের প্রার্থীর তালিকা বারবার রদবদল করা প্রভৃতি। আ’লীগের সঙ্গে শরিকদের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করতে গিয়ে তারা এই অনিয়ম করে। অভিযোগে আরো উল্লেখ কা হয়, বিভিন্ন জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে অবৈধভাবে প্রার্থীদের কারো মনোনয়নপত্র বাতিল, আবার কারো মনোনয়নপত্র বৈধ দেখায়। যে কারণে জাপার বেশ কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেয়ার পরও তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থীসংকট দেখা দিলে কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন। এছাড়াও, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকারি দল কোন নিয়মেরই তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু সেদিকে নির্বাচন কমিশন ঘুরেও দেখেনি। নবগঠিত বিএনএফকে নিবন্ধন দিতে চরম কূটচালের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। যা ছিল একেবারে নগ্ন আচরণ।

সংবিধান নিয়ে অপকৌশল: সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়ার জন্য প্রায়ই উচ্চ আদালতের রায়ের অজুহাত দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু একই রায়ের একাংশ মানা এবং আরেক অংশ না মানার অপকৌশল গ্রহণ করা হয়। রায়ে দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে ‘আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা যেতে পারে’ বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার উগ্র বাসনা থেকেই এই বিকল্পকে আমল দেয়া হয়নি। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একেবারে বাতিল করে দেবার কথাও বলা হয়নি। উচ্চ আদালত অপর একটি মামলায় এরশাদের সামরিক শাসনকেও অবৈধ বলে রায় দেন। এরশাদের আমলের কর্মকা-কে মার্জনা করা হলেও ‘অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবে এরশাদ তার দায় এড়াতে পারেন না বলে উল্লেখ করা হয়। রায় অনুযায়ী, এই ধরনের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে যথাযথভাবে শাস্তি (সুইটেবল পানিশ) দেয়া যেতে পারে। তবে সংসদ এবিষেয় আইন প্রণয়ন করতে পারে বলেও রায় দেয়া হয়। কিন্তু মহাজোটের সংসদে এরশাদকে শাস্তি দিতে কোন আইনপ্রণয়ন করা হয়নি। বরং মহাজোটের শরীক হিসেবে তাদের সকল রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। একে ‘দ্বিচারিতা’ বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ৭৮টি রাষ্ট্র: অতীতের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও ঐ নির্বাচনের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচন একতরফা হওয়া, প্রায় ৫ কোটি ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে ১৫৩ আসনে ভাগাভাগির ভিত্তিতে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাক্সিক্ষত পরিবেশ না থাকায় ২৮ রাষ্ট্রের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ৫৩ স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। এরমধ্যে কেবল ভারত ও ভুটানের ৪ পর্যবেক্ষক ঢাকায় আসেন বলে জানা যায়।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতিসহ অসংখ্য দেশ প্রধান বিরোধী দলসহ সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সকল ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানায়। কিন্তু সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।

https://dailysangram.info/post/530595