২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:৩০

অব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু ভয়ংকর

আরও ৯ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর পথে যাচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে মৃত্যু, বাড়ছে রোগী। এ পটভূমিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার জরুরি অবস্থা জারি কিংবা মহামারি ঘোষণার কথা বললেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা উড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গুর এমন আগ্রাসী পরিস্থিতির জন্য দায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের অদূরদর্শিতা এবং অব্যবস্থাপনা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর প্রাথমিক সেবা নিশ্চিত করতে নগরে সিটি করপোরেশনের চিকিৎসাকেন্দ্র না থাকা, মশা নিধনে দীর্ঘমেয়াদি কর্ম পরিকল্পনার অভাব, এডিস মশার বিস্তার ও রোগী ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য এ রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ৭৫৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত মারা যাওয়া ৯ জনের মধ্যে ঢাকার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরের একজন। এখন পর্যন্ত এ বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫৫ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এর বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের। এ সংখ্যা ৯১০ জন। আর ঢাকার ৮৪৫ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বর্তমানে ৫ হাজার ৯৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ৩ হাজার ৫২২ জন, আর বাকি ২ হাজার ৪১৫ জন ঢাকার বাইরে। গত ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৫৪৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এর মধ্যে ছাড়া পেয়েছেন ২১ হাজার ৪৫৫ জন। জুলাইয়ের শুরু থেকে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়। এ মাসের ২০ দিনে ১৯ হাজার ৫৬৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১০৮ জন মারা গেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। নতুন ধরনের কারণে উপসর্গ ছাড়া অনেকেই আক্রান্ত হয়ে হালকা অসুস্থতাবোধ করছেন। তবে প্রায়ই এ ভাইরাসে সৃষ্ট জ্বর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রাথমিকভাবে শনাক্ত ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। মৃত্যুও কমে আসে।

ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (ইসিডিসি) তথ্য বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। গত ৮ জুন পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ২২ লাখ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর বেশির ভাগ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে। সর্বোচ্চ রোগীর তালিকায় ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনা রয়েছে। তবে এসব দেশের মধ্যে আক্রান্ত রোগীর তুলনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।

ডেঙ্গু শনাক্তে দেশের কত মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, কারা আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংস্থাটি রাজধানী ঢাকার ২০টি সরকারি ও ৪৬টি বেসরকারি হাসপাতালে তথ্য প্রতিদিন তুলে ধরছে। এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে জেলা হাসপাতালের তথ্য। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারাদেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিলেও সে তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার আলাদা জোন তৈরিসহ সাতটি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অভিযোগ রয়েছে, তদারকির অভাবে হাসপাতালগুলোতে এর একটি নির্দেশনাও ব্যস্তবায়ন হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, রোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণারও ঘাটতি রয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি মাত্র কার্যালয় দিয়ে কার্যক্রম চলছে। ভাইরাস প্রতিনিয়তই চরিত্র বদলায়। আজকে যে ডেঙ্গু আমরা দেখছি তা আগে দেখা যায়নি। আগে থেকে মশার চরিত্র বদলের বিষয়টি জানা থাকলে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ সহজ হতো। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) আদলে দেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গড়ে তোলা উচিত ছিল। প্রতিটি জেলাতে একটি করে আইইডিসিআর শাখা করা জরুরি। এ ছাড়া ডেঙ্গুকে এখন শুধু মৌসুমি রোগ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা বা নিধন কর্মসূচি নিলে কাজ হবে না। একই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। রোগী কেন মারা যাচ্ছে, চিকিৎসার কোন পর্যায়ে মারা যাচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

আইইডিসিআর উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গেল ২৩ বছর মূলত মশা নিধন কর্মসূচি মৌসুমকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ রেখেছে সিটি করপোরেশন। এডিস মশা নির্মূল ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় জনস্বাস্থ্যের চিন্তাভাবনা উপেক্ষিত। এ দীর্ঘ সময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে নির্ধারিত কৌশলপত্র তৈরি হয়নি। রোগী শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছে। যে কারণে এবার মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এর বাইরে যেসব রোগী রয়েছে এবং মৃত্যু হচ্ছে তা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের (ডেন-১, ২, ৩ ও ৪) মধ্যে এবার একাধিক সক্রিয় রয়েছে। আমরা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ২০০ নমুনা সংগ্রহ করে তাতে ডেন-১ ও ৪-এ আক্রান্তের হার বেশি পেয়েছি। একাধিক ধরনে আক্রান্ত রোগীরা বেশি মারা যাচ্ছেন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, মশার চরিত্র বদল হয়েছে। মশা এখন রাতে-দিনে সবসময়ই কামড়াচ্ছে। অপরিষ্কার ও নোংরা পানিতেও এডিসের লার্ভা মিলছে। রোগীদের মধ্যে যারা শক সিনড্রোমে যাচ্ছেন, তাদের মৃত্যুহার বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নিধন কার্যক্রম সারা বছর চালাচ্ছে করপোরেশন। এ ছাড়া দুটি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশাল খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। গত বছর ডেঙ্গু জুলাইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ হাজার, অথচ এ বছর এরই মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে। তবু জরুরি অবস্থা জারি কিংবা মহামারি ঘোষণা করার মতো অবস্থা হয়নি। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে দোষারোপ না করে বছরজুড়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2307184578