২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:২৯

র্ধিত মেয়াদও শেষ, কাজ বাকি ৩০%

সুরমা নদীকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৯ সালে ১২০ কোটি ৮২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ থাকলেও তা এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো ৩০ শতাংশ কাজ বাকি।

এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পাউবো। এদিকে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ শেষ না হওয়ায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ভাঙন বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের এই অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি কমিটির বৈঠকে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজের ধীরগতি নিয়ে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের দেওয়া ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।

কমিটির পক্ষ থেকে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে উল্লেখ করে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শনের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।

সংসদীয় কমিটিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘সিলেট জেলার সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলায় দশগ্রাম, মাহতাবপুর ও রাজাপুর পরগনা বাজার এলাকার সুরমা নদীর উভয় তীরের ভাঙন হতে রক্ষা’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় এক কিলোমিটার ৬৫০ মিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও সাড়ে ১৮ কিলোমিটার চর খনন করা হবে।

২০২২ সালের জুন মাসে প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হয়। তবে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় নতুন করে মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। কিন্তু গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। পাউবো এরই মধ্যে এসংক্রান্ত চিঠি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এক হাজার ৫১৭টি বসতবাড়ি, ৩৪টি সড়ক, তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাদরাসা ও এতিমখানা, সাতটি মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। কৃষি, মৎস্য ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। এ ছাড়া চর খননের মাধ্যমে স্থানীয় নৌ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। এতে সামাজিক সুরক্ষাসহ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল জানান, করোনা পরিস্থিতি প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা স্থবিরতার সৃষ্টি করে। এরপর বরাদ্দের অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি অর্থ ছাড় না হওয়ায় অনেক সময় ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া দরপত্র (টেন্ডার) প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

তবে বৈঠকে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কমিটির সদস্য সামশুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এরপর অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্পে বরাদ্দ ঘাটতির কথা ঠিকাদারদের জানিয়ে দেন। এতে ঠিকাদাররা কাজের গতি কমিয়ে দেন, এমনকি কাজ বন্ধ করে দেন। পরে অর্থ বরাদ্দ হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শনের প্রস্তাব করেন।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না কেন, এর কারণ উদঘাটন করা জরুরি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা চলছে। প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

ঝুঁকির মুখে কয়েক গ্রাম
সিলেট অফিস জানায়, সিলেটের সদর উপজেলা ও বিশ্বনাথ উপজেলায় সুরমা নদীর উভয় তীর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও চর খনন প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে বিশ্বনাথের কয়েকটি গ্রাম। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে লামাকাজি ইউনিয়নের মাহতাবপুর ও কেশপুর। বিশেষ করে আতাপুর ও কেশবপুরের ভাঙন রোধ করা না গেলে লামাকাজি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এতে সিলেট-সুনামগঞ্জ আন্ত জেলা যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বনাথের লামাকাজি ইউনিয়নের রাজাপুর, পরগনা বাজার, আতাপুর, আজরাই ও কেশপুরের কয়েক হাজার পরিবার নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে মাহতাবপুর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় সেখানে বেশি মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে।

আজরাই গ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব এলাকায় প্রকল্পের কাজ এখনো বাকি রয়েছে সেসব এলাকায় শিগগির কাজ শুরু হবে বলে এক বছরের বেশি সময় আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাউবো। কিন্তু এরপর আর কোনো সাড়া নেই তাদের।’ তিনি বলেন, ‘মাহতাবপুরে ভাঙনের কারণে সুরমা নদীর ওপর থাকা লামাকাজি ব্রিজ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আতাপুর ও কেশবপুরের ভাঙন দ্রুত রোধ করা না গেলে ব্রিজটি একসময় ভাঙনের মুখে পড়বে। এমন ঘটলে সিলেট-সুনামগঞ্জ-বিশ্বনাথের সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়বে।’

লামাকাজির ইশবপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী অলিউর রহমান জনি অভিযোগ করে বলেন, ‘মাহতাবপুরের একাংশে ভাঙন রোধে ব্লক ফেলা হলেও অন্য অংশে রয়ে গেছে। মাহতাবপুর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা; তাই এদিকে দ্রুত নজর দেওয়া জরুরি। না হলে ১০০ থেকে ১২০টি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। প্রকল্প নেওয়া হলেও এ এলাকায় বড়জোর দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ফুট ব্লক বসানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আরো ৩০ শতাংশ বাকি রয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টিপাতের কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের পুরো কাজ হয়ে গেলে আর ঝুঁকি থাকবে না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/21/1300782