২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:২৬

বাঁশজাত কুটির শিল্পে চরম সঙ্কট

বাড়ির আশেপাশে বাঁশগাছ লাগানো আমাদের ঐতিহ্য। বাঙ্গালীর জীবনে বাঁশের রয়েছে নানামুখী ব্যবহার। ঘরের সোভা বাড়াতে বাঁশের তৈরি কুটির শিল্পের ব্যবহার অনেক পুরোনো। বাঁশের তৈরি বিভিন্ন তৈজস সামগ্রী বিদেশে ও রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঘরের স্থায়িত্ব মজবুত করতে বাঁশ ব্যবহার করে আসছে বহুদিন ধরে।

দেশে বিভিন্ন জাতের বাঁশ রয়েছে। কাজের ধরণ অনুযায়ী বাঁশের ব্যবহারও আলাদা আলাদা। ব্যবহারে আলাদা হলেও সব জাতের বাঁশের পাতা গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাঁশ ঝাড় থাকার কারণে অনেক সময় বসত বাড়ি ঝড়ের কবল থেকে ও রক্ষা পায়। শেরপুর পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ কঁচি বাঁশের উপরের অংশ সবজি হিসেবে ও রান্না করে খায়। মুখরোচক হওয়ায় চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বাঁশের সবজি খুব জনপ্রিয়। প্রাচীন কাল থেকে চাাহিদা থাকায় দেশের চাঁদপুর, সিলেট ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলাতে বাঁশের বাণিজ্যিক আবাদ ও হয়ে থাকে। দেশে শুধু নির্মাণ কাজেই শত শত টন বাঁশ প্রয়োজন হয়। এছাড়াও শিল্প খাতে তৈজসপত্র তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার তো আছেই।

এক অনুসন্ধানে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ জাতের বাঁশ রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে বড়বাঁশ, মোড়লবাঁশসহ ৩৩ জাতের বাঁশের ব্যবহার রয়েছে। আধুনিক সভ্যতায় এসেও গ্রামাঞ্চলের হাট বাজারগুলোতে এখনও বাঁশের তৈরি সাংসারিক প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র পাওয়া যায়। ধানসহ বিভিন্ন ফসল রাখার বেড়, ধানের মাচা, ঝাড়–, ময়লা ফেলার পাত্র এমন কি মাছ শিকারের উপকরণ খলই তৈরিতে পর্যন্ত বাঁশের ব্যবহার অনেক এগিয়ে। চাহিদার কারণে দাম বাড়লে ও মূলত একটি বাঁশের দামের উপর নির্ভর করে তৈজসপত্রের দাম। শেরপুর উত্তরর ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার এলাকা ভিত্তিক অনেক পরিবারই বাঁশ শিল্পের উপর নির্ভরশিল। তারা বিভিন্ন বাজারে বা গৃহস্থ বাড়িতে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে বাঁশ সংগ্রহ করে থাকে। সংগৃহিত বাঁশ পুকুর বা জলাশয়ের পানিতে কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে কাজের উপযোগি করে তোলে। পরে ভেজা বাঁশ দিয়ে তৈরি করে নানা উপকরণ। শেরপুর জেলা (উত্তর) এর স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি হয়ে বিক্রি করার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলাতেও বিক্রি হয়। সঠিক পরিচর্যা ও ব্যবহার করলে বাঁশ শিল্প গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভ‚মিকা রাখতে পারে এবং বাণিজ্যিকভাবে ও এ শিল্পে বেকার সমস্যা সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন কারিগররা। প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় বাঁশঝাড়ে কাক, বুলবুলি, শালিক, কানিবক, জাইঠেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এছাড়াও কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, গিরগিটি, মাকড়াসা, পিঁপড়া, কিছু সাপ বাঁশঝাড়ে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। জীববৈচিত্র রক্ষার পাশাপাশি ভ‚মিধস রোধে বাঁশের প্রকৃতিগত সহযোগিতা রয়েছে। শুধু তাই নয় সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে বাঁশের বাঁশি যুগ যুগ ধরে তুলনাহীন সুর মনে করে। ১৯৯৯ সালে জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে বাঁশের বাঁশি ছিল স্বগৌরবের। প্রখ্যাত বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী ওই সম্মেলনে ভারতীয় উপমাহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন। শেরপুর (উত্তর) এর গ্রামাঞ্চলের নারী পুরুষেরা বাঁশের তৈরি ধানের মাচা, ডোল, বেড়, মাছ ধরার বুড়–ং, ভাইর, খলই, খাঁচি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। মধুমাসে বাজারে আম, কাঁঠাল, জাম-লিচু উঠছে। হাট-বাজারে ভরে উঠছে আম জাম, কাঁঠাল, লিচুতে। আম-লিচু মহাজনদের কাছে এখন বাঁশের খাঁচির কদর বেশি। চাহিদা থাকায় গ্রামাঞ্চলের নারী-পুরুষেরা খাঁচি তৈরিতে ও ব্যস্ত। বছরের বেশির ভাগ মাসেই তাদের হাতে কাজ থাকে না। মধুমাস জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে আম লিচুর খাঁচি তৈরিতে সবারই কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়। বছরের অন্য সময়ে তেমন কোন কাজ থাকে না। মধুমাসে খাঁচির চাহিদা থাকায় কাজের চাপে তাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এই সময়ের আয় দিয়েই বছরের বেশিরভাগ সময় পার করতে হয় তাদের। বাঁশজাত দ্রব্যের কজন কারিগররা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, বর্তমানে বাঁশের দাম বেশি। একটি বাঁশের দাম ১শ’ ৮০ টাকা থেকে ২শ’ টাকা। একটি বাঁশ দিয়ে ৫ থেকে ৬টি খাঁচি তৈরি হয়। এক একটা খাঁচি বিক্রি হয় ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকায়। সারা দিনে ৬-৭টি খাঁচি তৈরি করা যায়। তাছাড়া প্লাস্টিকের দাপটে পূর্বের মত বাঁশের পণ্যের চাহিদা নেই। তবুও শত কষ্টে বাপ দাদার পৈত্রিক পেশা ধরে রেখেছেন তাঁরা।

https://dailyinqilab.com/national/article/588967