২১ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:২৫

কর্মী নিয়োগে নেই সুবাতাস

কুটনৈতিক তৎপরতায় ভাটা : বোয়েসেলের নিষ্কৃয়তায় চাহিদা যাচ্ছে অন্য দেশে

তেল সমৃদ্ধ পূর্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার হাত ছাড়া হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। কিন্ত ক‚টনৈতিক তৎপরতার অভাব এবং বোয়েসেলের নিষ্কৃয়তায় দেশটির অভিবাসী কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র নেপালসহ অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে। ক‚টনৈতিক তৎরতা বাড়াতে পারলে দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। একাধিক সূত্র এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

গত বছরের অক্টোবর মাসে ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদৌল্লাহ প্রথম বারের মতো তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরকালে দেশটিতে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশটিতে দালাল চক্রে দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্রুনাইয়ের সুলতানের ঢাকা সফরকালে বোয়েসেল ও দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে জনশক্তি রফতানিসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্ত যথাযথ ক‚টনৈতিক তৎপরতার অভাবে দেশটির সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারে বাড়ছে না গতি। ব্রুনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। হাই কমিশনের লেবার কাউন্সেলরের পদটি দীর্ঘ দিন যাবত শূন্য রয়েছে। ফলে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সুসর্ম্পক গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ব্রুনাইয়ের শ্রম মন্ত্রণালয় নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দেদারসে অভিবাসী কর্মী নিয়োগ করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেলের নিষ্কৃয়তায় ব্রুনাইয়ের কর্মী নিয়োগে সুবাতাস বইছে না। একাধিক জনশক্তি রফতানি কারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশটিতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্রæনাই সুলতানের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় দেশের শীর্ষ নেতার এ বৈঠক সফল বলেই সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সত্তর ও আশির দশকে ব্রæনাই বাংলাদেশের জনশক্তির বড় বাজার ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমে বাজারটি সঙ্কুচিত হতে থাকে।

একসময় ব্রæনাইয়ে প্রচুর লোক কাজের উদ্দেশ্যে যেত। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরেই এটি আর বাংলাদেশের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গত বছর অক্টোবর মাসে সুলতানের ঢাকা সফরকালে যে দুটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশ ব্রæনাই থেকে জ্বালানি আমদানি করতে এবং ব্রæনাইয়ে আগের মতো জনশক্তি পাঠাতে আগ্রহী। শ্রমশক্তি গ্রহণের বিষয়টিতে ব্রæনাইয়ের সুলতান ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন; একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আমিষজাতীয় পণ্য (মাছ-মাংস) আমদানির ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ও ব্রæনাইয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রম অভিবাসনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং ব্রæনাইয়ের সুলতানের প্রতিশ্রæতি গ্রহণে সফল হয়েছেন। ব্রæনাইয়ের সুলতানের সফরকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দু’দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

ওই সময়ে বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তৎকালিন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ দুই মুসলিম দেশের বৃহত্তর সুবিধার্থে বাংলাদেশ থেকে আরও অধিক হারে জনবল নিয়োগের জন্য ব্রæনাইয়ের সুলতানের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সুলতানের প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়। কিন্ত ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার ধরে রাখতে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।
বায়রার সাবেক ইসির সদস্য মোহাম্মদ আলী গতকাল ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে বলেন, শ্রম অভিবাসন বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রতি বছর ৬-৭ লাখ দক্ষ অদক্ষ কর্মী কাজের জন্য বিদেশে যান। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের ১৩টি রাষ্ট্র ঘিরে গড়ে উঠেছে আমাদের শ্রমবাজার। এসব অদক্ষ জনশক্তি ঘুরেফিরে এ ১৩টি দেশেই যাচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তি না পাঠিয়ে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো গেলে রেমিট্যান্সের হার হতো বহুগুণ।

ব্রæনাই থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত বুধবার একজন প্রবাসী ঠিকাদার ব্যবসায়ী ইনকিলাবকে বলেন, ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার বড় না হলেও বাংলাদেশি কর্মীদের প্রচুর চাহিদার রয়েছে। ব্রæনাইতে একজন নির্মাণ কর্মীর নি¤œতম মজুরি হচ্ছে ৫৫০ ব্রæনাই ডলার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন বেশি প্রয়োজন ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণা করা। দেশটিতে কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মী প্রয়োজন তার একটি মূল্যায়ন করা দরকার। শুধু মূল্যায়ন করে থেমে থাকলে হবে না; সে অনুযায়ী সরকারের যে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) রয়েছে, সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। এতে ব্রæনাইয়ের শ্রমবাজার দখলে রাখা সম্ভব হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ব্রæনাইয়ের সাথে চুক্তি হবার পর এখনো কর্মী প্রেরণের বিষয়টি চ‚ড়ান্ত হয়নি। তবে আমরা ট্যুরিজম, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। দেশটিতে কর্মী প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

গত বছর ব্রæনাইয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ঢাকা সফরকালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের সাথে বৈঠককালে প্রবাসী মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের কর্মীরা দায়িত্বশীল ও কর্তব্য পরায়ণ। বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশি কর্মীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি করতে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের অনিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করে এবং গুণগত অভিবাসন নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ বৈঠকে ব্রæনাইয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ব্রæনাই মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে দুদেশের সংস্কৃতির মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাই ব্রæনাইয়ের নিয়োগকারী এবং বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।’ তিনি বলেন, ‘ব্রæনাই সরকার অভিবাসী কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধে সদা তৎপর। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ-ব্রæনাই মানবপাচার প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ব্রæনাইয়ের সুলতানের ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ব্রæনাইয়ে কর্মী প্রেরণ বিষয়ে দুদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও সম্প্রসারিত ও নিরাপদ করবে।

বিএমইটির সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সউদীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫০ হাজার ৯৮৮জন নারী পুরুষ কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৪৭১ জন গেছে সউদীতে, মালয়েশিয়ায় গেছে ১৫ হাজার ৫৩৬ জন এবং ব্রæনাইতে গেছে মাত্র ১৯৫জন কর্মী।

বিএমইটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্রæনাই শ্রমবাজার বাংলাদেশি কর্মীদের দখলে ছিল। সে সময়ে আট হাজারেরও অধিক বাংলাদেশি কর্মীর ব্রæনাইতে কর্মসংস্থান হয়ে ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে তা অর্ধেকে নেমে আসে, যার পতনের ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এই বাজার নেপালের অধীনে চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ব্রæনাইস্থ বাংলাদেশ দুতালয়ের সাবেক ওয়েল ফেয়ার অফিসার মোহাম্মদ জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে এর প্রকৃত কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ২০০৫ সালে দুতাবাসে যোগদানের সময় মাত্র ১৯১ জন বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান থেকে ক্রমানয়ে তা উন্নতি করে আমি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮৫৮৭ জন বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানে উন্নতিকরণে ভ‚মিকা রেখেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালে হতে আমার অবর্তমানে তা আজ নিম্নমুখী। আমি কষ্ট পাই যখন দেখি অনেকের কঠোর পরিশ্রমে গড়া শ্রমবাজার আজ ধংসের মুখে। তিনি বলেন, অতীতে হাইকমিশনারগণ তাদের প্রেরিত পত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ব্রæনাই শ্রমবাজার হারানোর যে আশঙ্কা করেছিলেন তা যেন আজ বাস্তবে প্রমাণিত হচ্ছে।

ব্রæনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা গত বুধবার দারুসসালাম থেকে দেশটিতে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, সাড়ে ৪ লাখের জনসংখ্যার দেশ ব্রæনাই একটি ছোট রাষ্ট্র। এখানে বেতন কম। নির্মাণ, বাগান, পেইন্টারসহ নানা খাতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে কাজ করছে। হাই কমিশনের ব্যর্থতার দরুণ দেশটির শ্রমবাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে হাই কমিশনার বলেন, ওয়েল্ডারসহ বিভিন্ন খাতে কর্মী নিতে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আগে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়েছিল। কয়েকজন চিহ্নিত দালালকে গ্রেফতার করে দেশেও পাঠানো হয়েছিল। দালাল চক্রের অপতৎপরতা বন্ধের দরুণ বোয়েসেলের সাথে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চুক্তি হয়েছে এবং প্রতি মাসেই উভয় পক্ষের মাঝে মিটিং হচ্ছে বলেও হাই কমিশনার উল্লেখ করেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/588989