১৯ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১:০১

১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ভোটদানের রেকর্ড

সোমবার রাতে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ফলাফল কেন্দ্র থেকে ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মুনির হোসাইন খান। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফল থেকে জানা যায়, নির্বাচনে ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম ৫ হাজার ৬০৯ ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনী ফল বলছে: উক্ত আসনে ভোটার সংখ্যা যেখানে সোয়া তিন লাখেরও বেশি (৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন), সেখানে সর্বমোট ভোট পড়েছে মাত্র ৩৭ হাজার ৪২০টি। এর মধ্যে ৩৮৩টি ভোট বাতিল হয়েছে। মোট ১২৪টি কেন্দ্রে ১১.৫১ শতাংশ ভোট পড়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ নং ওয়ার্ড এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৭ আসন। ২০০৮ সালে গঠিত এই আসনের উক্ত এলাকাগুলো আগে ঢাকা-৫ আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নতুন এই আসন সৃষ্টির পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রধান তিন প্রার্থী ছিলেন সেনাবাহিনীর সাবেক তিন কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে প্রার্থী হয়ে জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৬ ভোট পেয়ে বিএনপি নেতা প্রয়াত ব্রি. জে. (অব.) হান্নান শাহকে (৫৬ হাজার ২৬৭ ভোট) পরাজিত করেন।

নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন মে. জে. (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম। ওই নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৬২ হাজার ১৪২ জন। ১ লাখ ৯২ হাজার ৭২৭ জন ভোট দিয়েছিলেন, ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭৩.৫২ শতাংশ। অর্থাৎ, ওই নির্বাচনে এবারের উপনির্বাচনের চেয়ে ৬.৩৯ গুণ বেশি ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন- যেখানে মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৮ জন। ভোট দেন ২ লাখ ৮ হাজার ৬৮৭ জন। ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৩৬ শতাংশ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ফারুক ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬১০ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আন্দালিব রহমান পার্থ (৩৮ হাজার ৬৩৯ ভোট)। অর্থাৎ, ওই নির্বাচনে এবারের উপনির্বাচনের চেয়ে ৫.৭৭ গুণ বেশি ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।

এর আগে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এরশাদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলে এবং তৎকালীন সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) অখ্যাত প্রার্থী এস এম আবুল কালাম আজাদ টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে ৪৩ হাজার ৫৮৫ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ হান্নান মৃধা ফুটবল প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৪৬ ভোট। ২ লাখ ৯০ হাজার ২৭৮ ভোটারের মধ্যে ওই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৫১ হাজার ৬৩১ জন। ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৭.৭৯ শতাংশ। উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে উক্ত নির্বাচনের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ না থাকলেও ওই নির্বাচনে এবারের উপনির্বাচনের তুলনায় অনেক বেশি ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।

সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনে যে কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ছিল এবারের উপনির্বাচনে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বারবার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানালেও প্রতি ১০০ জন ভোটারের মধ্যে ১২ জনেরও কম (১১.৫১ শতাংশ) ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

সোয়া তিন লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র যে ৪৭ হাজার ভোট পড়েছে সেগুলো নিয়েও রয়েছে সন্দেহ এবং কারচুপির অভিযোগ। ভোটের দিন প্রথম আলো অনলাইনের প্রতিবেদনে (এটা কোথায় না হয়: জাল ভোট নিয়ে আ.লীগ নেতা) বলা হয়, ‘নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, ওই কেন্দ্রে আজ সোমবার ভোট গ্রহণ শুরুর পর সকাল ৯টা পর্যন্ত ভোটের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। দুপুর পৌনে ১২টায় তা দাঁড়ায় ৩ শতাংশে। বেলা দুইটার পর নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এরপর বেলা সোয়া তিনটায় দেখা যায়, সেখানে ভোট গ্রহণের হার বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে’।
প্রতিবেদনের আরেক অংশে বলা হয়: নৌকার ব্যাজধারী নেতাকর্মীদের এই কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের কারণে সেখানে অন্য চার কেন্দ্রের চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে- প্রতিবেদকের এসব কথা শুনে মুচকি হেসে ফেরদৌস কবির (গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) বলেন, এটা কোথায় না হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও তো এটা হয়। কেন্দ্র থেকে ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রবীণ এক ভোটার প্রথম আলো’কে বলেন, ‘ভেতরে তো সব নৌকার লোক। তারা নিজেদের মতো করে যা করার তাই করছেন।’ নৌকার ব্যাজধারীদের জাল ভোট দেয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র সাহা প্রথম আলো’কে বলেন, ‘আমি খেয়াল করিনি।’

গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার বাসিন্দারা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় সকালে ভোটার সংখ্যা কম হতে পারে বলে সোমবার বেলা ১১টায় মন্তব্য করেছিলেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। কিন্তু, মানবজমিনের প্রতিবেদক জানান, ‘দিন শেষেও ভোটারদের লাইন কোনো কেন্দ্রেই চোখে পড়েনি। সকালবেলা মনে হয়েছিল বেলা বাড়লে ভোটার আসবে, লাইনে থেকে ভোটাররা সিরিয়াল ধরে গিয়ে ভোট দেবেন। কিন্তু তেমনটি হয়নি। দুপুরে মনে করা হয়েছিল হয়তো দুপুরের খাবারের পরে ভোটার আসবে। সেটিও হয়নি। শেষ বিকালেও ভোটারের উপস্থিতি আশা করেও ফলাফল শূন্য’।

https://mzamin.com/news.php?news=65318