১৯ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১২:৫৭

নির্বাচনের খারাপ বার্তা পেলেন বিদেশিরা

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমের (হিরো আলম) ওপর হামলা বিদেশিদের কাছে পরিষ্কার বার্তা। বিষয়টি মঙ্গলবার আরও স্পষ্ট হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গে পুলিশ ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায়।

এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে-এমন বার্তা পেলেন না তারা। এছাড়া এমন এক সময় এই হামলা হলো-যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ঢাকায় সফর করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলও সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য আগামীতে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে, এমনটি বলা যাবে না। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন।

এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। তীব্র নিন্দা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ জানিয়ে হামলাকারীদের জবাবহিদিতার আওতায় আনতে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে সোমবার বিকালে রাজধানীর বনানীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলা করে নৌকার ব্যাজধারীরা। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই রাস্তায় ফেলে তাকে উপর্যুপরি পেটানো হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। সংস্থাটির এই সফরের উদ্দেশ্য হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি এই সফরের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু তাদের চোখের সামনেই হিরো আলমের ওপর হামলা হয়েছে। এটি তাদের কাছে পরিষ্কার একটি বার্তা। তিনি বলেন, তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। এখানে কিছু বলবে না। এই তথ্য তারা তাদের প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট জমা দেবে। সেই অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল সফর করে গেছে। তারাও বিষয়টি নজরদারি করছে। সবকিছু মিলে বিদেশিদের কাছে পরিষ্কার বার্তা। এখন তাদের সিদ্ধান্ত তারা নেবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব ঘটনা অনিভিপ্রেত। এছাড়া এগুলো অভ্যন্তরীণ হলেও বিদেশিদেরও চোখ এড়াবে না। অবশ্যই এটা তাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা হিসাবে যাবে।’

জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল আলীম যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেকটা শেষের দিকের একটি উপনির্বাচন ছিল ঢাকা-১৭ আসনে। এখানে বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। সেই অবস্থায়ও এই হামলা হতাশাজনক। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বর্তমানে বাংলাদেশে সফরে রয়েছেন। ওই প্রতিনিধিদলটি দেশের নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করছে। এ অবস্থায় একজন প্রার্থীর ওপর হামলা তাদের জন্য নেতিবাচক বার্তা। তাদের চোখের সামনে এটি হলো। নিশ্চয়ই প্রতিনিধিদলটি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই হামলার ভিডিও দেখেছে। পত্রিকায় সংবাদ পড়েছে। গণমাধ্যমের এসব ডকুমেন্টকে তারা রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করবে।

অর্থাৎ প্রতিনিধিদল এমন সব ধারণা নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করবে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর হামলা হয়। এসব ঘটনা নিয়ে দলটি তাদের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে। সেটি হবে ঋণাত্মক (নেতিবাচক)। আবদুল আলীম বলেন, এই ঘটনা প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশের শক্ত ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে ভূমিকা চোখে পড়েনি। ফলে এসব ঘটনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ভালো কিছু নয়।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এখানে দুটি বিষয় পরিষ্কার। প্রথমত, নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের আস্থাহীনতা এবং হিরো আলমের ওপর হামলা। তিনি বলেন, একটি নির্বাচনে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পড়েছে। ফলে পৃথিবীর মানুষের কাছে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ যে, এখানে মানুষ ভোট দিতে যায় না এবং ভোটের প্রতি আস্থা নেই। কারণ মানুষের মনে এই ধারণা তৈরি হয়েছে, এখানে ভোটের নামে তামাশা হবে। এ অবস্থা হলে কে ভোট দিতে যাবে।

দ্বিতীয়ত, ভোটের দিনে একজন প্রার্থীর ওপর ন্যক্কারজনক হামলা। বিদেশিরা এসব নজরদারি করছে। ইতোমধ্যে তারা বুঝে গেছে আগামীতে কী নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় প্রতিনিধিদল বর্তমানে সফরে রয়েছে। তাদের সামনেই এই হামলা হলো। ফলে এটি পরিষ্কার যে, ভোট কীভাবে হয় এবং ভোটের নামে কী হয়। আবু আহমেদের মতে, সবকিছু মিলে এটি আগামীর বাংলাদেশের জন্য ভালো কোনো বার্তা নেই।

এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় জাতিসংঘ। ঢাকায় নিযুক্ত সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস এব এক টুইট বার্তায় এই উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, সহিংসতামুক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ সবার মৌলিক অধিকার। সেটিকে রক্ষা করা উচিত।

এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মঙ্গলবার এক টুইটে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, হিরো আলমের ওপর এ ধরনের হামলা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় দেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে আতঙ্কের বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অবিলম্বে এ হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নির্বাচনের আগে-পরে অবশ্যই মানবাধিকারকে সব সময় সমুন্নত রাখতে হবে।

এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। যে কোনো ধরনের সহিংসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই।

অন্যদিকে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত ২৪ মে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িতদের ভিসা দেবে না দেশটি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে-ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান।

পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে বার্তা দিতে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। এরপরই এই হামলার ঘটনা ঘটল। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় নির্বাচনি ও রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/697467