১৯ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১২:৪৪

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে রেকর্ড ১৩ জনের মৃত্যু

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে রেকর্ড ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে। একই সময়ে নতুন করে ১ হাজার ৫৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজারে।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গুবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নতুন করে আরও এক হাজার ৫৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৭৭৯ জন ঢাকায় চিকিৎসাধীন। বাকি ৭৫৪ জন রাজধানীর বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই সময়ে নতুন করে আরও ১৩ জন মারা গেছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে।

বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ৫ হাজার ৫৬৯ জন ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিন হাজার ৪৪৩ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১২৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ২৪ হাজার রোগী। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১৮ হাজার ৩০৪ জন। আর চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১২৭ জন।

২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরমধ্যে গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, মানিকনগর এবং সবুজবাগ এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছে উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও এবং বাড্ডা থেকে। রাশেদা সুলতানা বলেন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সব হাসপাতালেই পর্যাপ্ত ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট দেওয়া আছে। আরও প্রয়োজন হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ব্যবস্থা নেবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এটি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মশক নিধনে সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমরা ডেঙ্গু দমনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হবেন ও প্রাণ হারাবেন।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির দরকার হয় না। তবে ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা করলে রোগী শক সিন্ড্রোমে চলে যাবে। আর তখন ওই রোগীকে সামাল দেওয়া কঠিন। তাই কারও জ্বর হলেই এনএস১ পরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে কি না নিশ্চিত হতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৯ নির্দেশনা : এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ৯টি নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, দেশে এডিস মশার বিস্তার ও এর মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন, সতর্ক হওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

নির্দেশনাগুলো হলো-অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর আশপাশে যেসব জায়গায় স্বচ্ছ পানি জমার সম্ভাবনা থাকে, সেসব জায়গা চিহ্নিত করে একদিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে; অব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস অথবা উল্টে রাখতে হবে; অব্যবহৃত হাই কমোডে হারপিক ঢেলে ঢাকনা বন্ধ করে রাখতে হবে; লো-কমোডের প্যানে হারপিক ঢেলে বস্তা বা অন্য কিছু দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে; কোনো জায়গায় জমা পানি থাকলে লার্ভিসাইড স্প্রে করতে হবে অথবা জমা পানি নিষ্কাশন করতে হবে; ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে; ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমে সিটি করপোরেশন/পৌরসভার সঙ্গে সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ডেঙ্গু জ্বরে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সুস্থ থাকতে হবে; শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো অবহিত করতে হবে এবং ওপরের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগ রাখতে হবে।

চট্টগ্রামে ২ জনের মৃত্যু
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেংগুতে নতুন করে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মংগলবার চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাবে এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে ডে্গংুতে ২০ জনের মৃত্যু হলো।

এদিকে গতকাল মংগলবার ২৪ ঘন্টায় ডেংগু আক্রান্ত হয়েছে আরও ১০১ জন। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূএ বলছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ১০১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেংগু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৬৫জনে। এছাড়া শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন। গতকাল বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ডে্গংু রোগী ভর্তি ছিল ২৩০জন।

এদিকে চট্টগ্রামে ডেংগুতে আক্রান্ত হচেছ বেশী শিশুরা। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুরহারে এগিয়ে শিশুরা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে ৩৫৪ জন শিশু আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মারা গেছে নয় জন। তবে ১১ বছরের নীচে শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। এ কারণে শিশুদের জ্বর হলেই পেরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট ২০ জন ডেংগুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এরমধ্যে নয় জনই শিশু। মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই ১১ বছরের মধ্যে।
খুমেক হাসপাতালে ডেঙ্গুতে
নারীর মৃত্যু ভর্তি ৪০

খুলনা ব্যুরো : খুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সবুরুন্নেসা (৬৮) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বর্তমানে হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪০ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা ডাক্তার সুহাস রঞ্জন হালদার জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সবুরুন্নেছা গত ১৬ জুলাই মোংলা থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়। মঙ্গলবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি আরো জানান, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় ১৮ জন রোগী ভর্তি হয়। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২০ জন। চলতি বছরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্বমোট ১৫৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

ডেঙ্গুর সংক্রমণ পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে
নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা: দিন যত গড়াচ্ছে নারায়ণগঞ্জে তত বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জে ১০টি আইসিইউ শয্যাসহ ৬টি ডেঙ্গু কর্নার চালু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। হাসপাতাল গুলোতে ১৮ দিনে ভর্তি হয়েছে ১০৮ জন। জেলায় এ পর্যন্ত কোন রোগীর মৃত্যু হয়নি তবে ঢাকায় গিয়ে মারা যেতে পারে তার হিসেব নেই নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জনের কাছে। এডিস মশার প্রতিরোধে মশক নিধন, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা প্রদক্ষেপ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এছাড়া বাসা বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া গেলে করছে জরিমানা।

নারায়ণগঞ্জে দিন যত গড়াচ্ছে তত বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জেলা ও উপজেলায় ১০টি আইসিইউ শয্যাসহ ৬টি ডেঙ্গু কর্নার চালু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখন পর্যন্ত দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছে। আর বেশী আক্রান্তদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এবং অল্প আক্রান্তদের চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। গত ১৩ জুন প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয় নারায়ণগঞ্জ ৩ শ’ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে। এরপর থেকে একজন দু‘জন করে হাসপাতালটিতে এক মাসে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গেলো সাপ্তাহে। এখন দিনে ১৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ৩’শ শয্যার হাসপাতালে। একই ভাবে রোগী বাড়ছে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতেও। সেখানেও প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে নারী, বাদ যাচ্ছে না শিশুরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছে নারী ও শিশুরা। রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, নানা উপসর্গ নিয়ে এসে পরীক্ষা করে জানতে পারেন ডেঙ্গুতে আকান্ত হয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/530316