১৮ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:১১

২৩ বছরের মধ্যে মৃত্যু ও আক্রান্ত সর্বোচ্চ

দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গতকাল সোমবার এক দিনে ডেঙ্গুতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এক দিনে এটাই সর্বাধিক মৃত্যু। এ নিয়ে এ বছর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১১৪।

একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৫৮৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৩ বছরের প্রথম সাত মাসে এ বছরই সর্বাধিকসংখ্যক রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ বছর প্রথম সাত মাসে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ২২ হাজার ৪৬৭ জন রোগী। দেশের এমন পর্যায়কে ‘জনস্বাস্থ্য জরুরি’ পরিস্থিতি বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি শয্যাও খালি নেই। হাসপাতালগুলোর মেঝে ও করিডরে রেখে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে চিকিৎসাধীন রোগী হাসপাতাল ছাড়ার আগেই তার শয্যার পাশে অন্য রোগী অপেক্ষায় থাকছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি, ২৮১ জন রোগী মারা যায়।
এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে সাতজন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যায়। গত বছর জুলাইয়ে এই সময় পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল তিনজনের, ২০২১ সালে মারা যায় ১২ জন, ২০২০ সালে কারো মৃত্যু হয়নি, ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ৩৫ জনের।

২০১৩ সাল থেকে গত ১১ বছরে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি, ২২ হাজার ৪৬৭ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ১৮ হাজার ৪৬১ রোগী আক্রান্ত হয়।

২০২২ সালে দুই হাজার ৬৬০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। ২০২১ সালে দুই হাজার ৬৫৮ জন ভর্তি হয়। ২০১৮ সালে এক হাজার ৩৭৩ জন, ২০১৭ সালে ৯৮৬ জন, ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ২১ জন, ২০১৫ সালে ২১৭ জন, ২০১৪ সালে ১২৩ জন, ২০১৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৬৮ জন ভর্তি হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট পাঁচ হাজার ৪৪১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে দুই হাজার ৯৪ জন। পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বেশির ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছরে নিচে। এই বয়সে মৃত্যুর হার বেশি।

এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২২ হাজার ৪৬৭ জন রোগী মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের ১১ হাজার ২১৩ জন, যা মোট রোগীর প্রায় অর্ধেক। শূন্য থেকে পাঁচ বছরের নিচে আক্রান্ত এক হাজার ৫১৬ জন। পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সের এক হাজার ৬১৫ জন। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের রোগী তিন হাজার ৫৭৮ জন। ৪০ থেকে ৬০ বছরের রোগী তিন হাজার ৫১৭ জন। ৬০ বছরে বেশি রোগী এক হাজার জন।

আক্রান্তদের মধ্যে মারা যাওয়া ১১৪ জনের মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের ৪৭ জন। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সের পাঁচজন। পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সের সাতজন, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের ১২ জন। ৪০ থেকে ৬০ বছরের ২৭ জন। ৬০ বছরের বেশি ১৬ জন।
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘ডেঙ্গু বাড়বে। ক্লাস্টার জোন কোনগুলো, সেগুলো আমাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা প্রতিদিন সিটি করপোরেশনকে জানাচ্ছে। কোন জায়গায় মশা বেশি, আমরা কিন্তু ওই এলাকাগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছি। লম্বা বেল্ট করে শনির আখড়া থেকে বাড্ডা পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে।’

অধ্যাপক খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসার প্রটোকল একটাই। সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে বলা হয়েছে। সারা বছর চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ চলে। চিকিৎসকরা যেন প্রটোকলের বাইরে অন্য চিকিৎসা না করেন। এতেই রোগী ভালো থাকবে। যাদের কো-মরবিডিটি আছে, যেমন—ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্যান্সার, তাদের ডেঙ্গু হলে অবশ্যই হাসপাতালে আসতে হবে।

ডেঙ্গুর ২৩ বছর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিল পাঁচ হাজার ৫৫১ জন ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে আক্রান্ত দুই হাজার ৪৩০ ও মৃত্যু ৪৪, ২০০২ সালে আক্রান্ত ছয় হাজার ২৩২ ও মৃত্যু ৫৮, ২০০৩ সালে আক্রান্ত ৪৮৬ ও মৃত্যু ১০, ২০০৫ সালে আক্রান্ত এক হাজার ৪৮ ও মৃত্যু চার, ২০০৬ সালে আক্রান্ত দুই হাজার ২০০ ও মৃত্যু ১১, ২০০৭ সালে আক্রান্ত ৪০৬ ও মৃত্যু নেই, ২০০৮ সালে আক্রান্ত এক হাজার ১৫৩ ও মৃত্যু নেই, ২০০৯ সালে আক্রান্ত ৪০৪ ও মৃত্যু নেই, ২০১০ সালে আক্রান্ত ৪০৯ ও মৃত্যু নেই, ২০১১ সালে আক্রান্ত এক হাজার ৩৫৯ ও মৃত্যু ছয়, ২০১২ সালে আক্রান্ত ৬৭১ ও মৃত্যু এক, ২০১৩ সালে আক্রান্ত এক হাজার ৭৪৯ ও মৃত্যু দুই, ২০১৪ সালে আক্রান্ত ৩৭৫ ও মৃত্যু নেই, ২০১৫ সালে আক্রান্ত তিন হাজার ১৬২ ও মৃত্যু ছয়, ২০১৬ সালে আক্রান্ত ছয় হাজার ৬০ ও মৃত্যু ১৪, ২০১৭ সালে আক্রান্ত দুই হাজার ৭৬৫ ও মৃত্যু আট, ২০১৮ সালে আক্রান্ত ১০ হাজার ১৪৮ ও মৃত্যু ২৬, ২০১৯ সালে আক্রান্ত এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ ও মৃত্যু ১৭৯, ২০২০ সালে আক্রান্ত এক হাজার ৪০৫ ও মৃত্যু ১০৫, ২০২১ সালে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪২৯ ও মৃত্যু ১০৫, ২০২২ সালে আক্রান্ত ৬২ হাজার ৩৮২ জন ও মৃত্যু ১৮১ জন।
‘জনস্বাস্থ্য জরুরি’ পরিস্থিতি

দেশের এমন পর্যায়কে ‘জনস্বাস্থ্য জরুরি’ পরিস্থিতি বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন আর শুধু শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই, এটি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। অজানা নয়, এমন কোনো রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যদি অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, এ পরিস্থিতিকে মহামারি বলে। রোগটিতে অনেক মৃত্যু না হলেও এটাকে মহামারি বলে। আবার কোনো রোগের সংক্রমণ পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন সেটাকে জনস্বাস্থ্য সংকট বলে। এখন জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি চলছে, যা জাতীয় উদ্বেগের কারণ।’
রোগীর সঠিক তথ্য নেই

সারা দেশে প্রতিদিন মোট কতসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে, এর সঠিক কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। গতকাল দেশের চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন এমআইএস বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘টেস্টের তথ্যগুলো আমাদের কাছে নেই। এটা কভিডের সময় আমাদের জন্য রাখা সম্ভব ছিল। কারণ সেটার জন্য ডিজিটাল সিস্টেম গড়ে তুলেছিলাম। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সরবরাহ করেছিলাম। এ জন্য সেই সময়ে আমাদের সিস্টেমের মাধ্যমে পুরো তথ্য আমরা পেয়ে যেতাম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। প্রতিটি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত আছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/18/1299802