১৮ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:০৩

ভাবমূর্তি সঙ্কটে অনেক ব্যাংক

ডলার সঙ্কটে আমদানির ব্যয় যথাসময়ে পরিশোধ ব্যাহত

ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্য আমদানির দায় যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। কোনো কোনো ব্যাংকের এলসির দায় মেটাতে ১০ থেকে ১২ বার পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। ডলার সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে অনেক ব্যাংক ও গ্রাহক। নিরুপায় অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও দ্বারস্থ হচ্ছেন। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, এ কারণে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু ব্যাংকের ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে, তাও আবার চাহিদার যৎসামান্য। এমনি পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকগুলো ভাবমূর্তি সঙ্কটে ভুগছে। এতে নতুন এলসি খুলতে তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। এ জন্য বাড়তি ফি বা চার্জ গুনতে হচ্ছে ডলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলোর পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র স্থাপন বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যসব পণ্যের এলসি খোলা যাবে না। আবার পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুললেও ডলারের সংস্থান করে এলসি খুলতে বলা হয়েছিল। পাশাপাশি বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গ্রাহকদের শত ভাগ মার্জিন অর্থাৎ শত ভাগ অর্থের সংস্থান করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এতে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার কমে এসেছে। কিন্তু এর পরেও ডলারের যেটুকু চাহিদা রয়েছে তার একটি অংশ ব্যাংক সংগ্রহ করতে পারছে না। বাজার থেকে ডলার সংস্থান করতে না পারায় বাধ্য হয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসছে। কিন্তু প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে পারছে না। এর পরেও বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের উপরে বিক্রি করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের নির্দেশেই ডিজেল, সার, ভোগ্যপণ্য, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল। পণ্যও দেশে চলে এসেছে। কিন্তু ডলার সঙ্কটে তা যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছেন না। ওই সূত্র জানিয়েছে, অগ্রাধিকতার ভিত্তিতে ২০ কোটি ডলার চাওয়া হলে দেয়া হয় সর্বোচ্চ ২ কোটি ডলার। এমনও পণ্য আমদানির দায় আছে যা ৩০ বারেরও বেশি সময় বাড়ানো হয়েছে। এভাবে পুঞ্জীভূত বকেয়া এলসির দায় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। যথা সময়ে এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে বাড়তি জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তির সঙ্কটে ভুগছেন তারা। আগে যেখানে পণ্য আমদানির জন্য সরাসরি বিদেশী ব্যাংকের সাথে এলসি খোলা যেতো, সেখানে এখন তৃতীয় কোনো ব্যাংক বা সংস্থার গ্যারান্টি নিতে হচ্ছে। আর এ জন্য বাড়তি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।

অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, অগ্রাধিকার পণ্য সার, গম আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল। পণ্যও যথাসময়ে দেশে এসেছে। কিন্তু গ্রাহক ডলার সংস্থান করতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংকও বিদেশী ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকের দায় পরিশোধ করতে পারছে না। এতে ব্যাংকেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ওই ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, আগে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হতো তা দিয়ে সহজেই পণ্য আমদানি ব্যয় মেটানো যেতো। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে বকেযা এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় পুঁঞ্জীভূত বকেয়া দায়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর ফলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হচ্ছে তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও কেউ ডলার বিক্রি করছে না। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আর আগের মতো ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। আর এ কারণেই বকেয়া এলসির দায় বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) পণ্য আমদানির জন্য ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৯৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমেছে ১৪.১৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে ও ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি ব্যয় কমে গেছে। কিন্তু বিপরীতে যে পরিমাণ রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স এসেছে তার তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি। পাশাপাশি বকেয়া এলসির দায়ও রয়েছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলো যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ পরিস্থিতি সামনে আরো খারাপ হতে পারে। কারণ বিভিন্ন প্রকল্পের ঋণের দায় পরিশোধের চাপ বেড়ে যাবে। কিন্তু বিপরীতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে ও কাক্সিক্ষত হারে বিদেশী ঋণ না ছাড় হলে ডলার সঙ্কট আরো বেড়ে যেতে পারে। এটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ থেকে উত্তরণের একটি পথ আর তা হলো ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য বিদেশে নতুন নতুন শ্রমের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। একই সাথে রফতানি আয় বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/763029/