১৮ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:০২

ভোটারবিহীন নির্বাচনেও প্রার্থীকে মারধর

ভোট শুরুর পর কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের তেমন উপস্থিতি ছিল না। এতে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে নির্বাচনী কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিই ছিল বেশি। দুপুরের দিকে অনিয়ম ও নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী। আরেক আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মারধরের মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন।

বিএনপি-জামায়াত এই নির্বাচন বর্জন করায় অনেকটা ভোটারবিহীন হওয়ার ধারণা আগেই করা হচ্ছিল। সেই ধারণাই সত্যি হলো ভোটের দিনে। ভোটগ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল অনেকটা একই দৃশ্য। সুনসান-নীরব। কোনো কেন্দ্রের সামনেই দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েনি। দিন শেষে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ ভোট পড়তে পারে বলে জানানো হয়।

গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ আসনের ১২৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এই প্রথম কোনো সংসদীয় আসনে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ হলো। দিনভর শান্তিপূর্ণ ভোট চললেও বিকেলে ভোট শেষের ঘণ্টাখানেক আগে একটি কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। মারধর থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে হিরো আলম দৌড়ে পালান। হামলাকারীরা এ সময় তাকে পেছন থেকে ধাওয়া দেন। একপর্যায়ে তিনি বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গিয়ে একটি রিকশায় ওঠেন। পরে গাড়িতে করে চলে যান।

এর আগে সকালে হিরো আলম তার এজেন্টদের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন। বনানী মডেল স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে একতারা প্রতীকের এই প্রার্থী বলেন, ‘যখনই বলতেছে একতারার লোক, হিরো আলমের লোক, তখনই কিন্তু বের করে দিতেছে। এই রকম করে এজেন্ট বের করে দেয়ার মানে হইল, তারা একতরফা তাদের এজেন্ট দিয়ে সিল মারার চেষ্টা করতেছে।’

আর দুপুর আসতে না আসতেই অনিয়ম ও নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন ট্রাক প্রতীকের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মো: তারেকুল ইসলাম ভূঞা। ভোট বর্জনের এই ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, গণমাধ্যমে দেখলাম। অভিযোগ থাকতে পারে, এটা সত্য বা মিথ্যা, তা কিন্তু নয়। সত্যতা যাচাই করে আইনি ব্যবস্থা নেব। তবে এত অল্প সময়ে কেন বর্জন করলেন বুঝতে পারলাম না।

বেলা ১১টার দিকে গুলশান মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। ভোট দিয়ে তিনি বলেন, ‘চার দিকে শুধু নৌকার ভোট। নৌকা বিজয়ী হবে। এর তো কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশে।

অন্য দিকে, ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে পিটিয়ে আহত করেছে নৌকা প্রতীকের সমর্থকেরা। বেলা সোয়া ৩টার দিকে রাজধানীর বনানী এলাকার বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও নির্বিকার ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শনে যান হিরো আলম। তিনি ভোটকেন্দ্রের ফটকে পৌঁছানোর পর পরই একদল যুবক ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে টিপন্নি কাটতে থাকেন। হিরো আলম তাদের উপেক্ষা করে তার কয়েকজন সমর্থককে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়েন। ভোটকেন্দ্রের নিচতলায় একটি কক্ষের সামনে নৌকার ব্যাজধারীদের প্রথম বাধার মুখে পড়েন হিরো আলম।

তাদের বলতে শোনা যায়, ‘এটা কি টিকটক করার জায়গা।’ এ সময় সেখানে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় পুলিশ সদস্যরা হিরো আলমের সামনে দাঁড়িয়ে যান। তারা তাকে বারান্দা থেকে মাঠের দিকে আনার উদ্যোগ নেন। কিছু দূর আসার পরই পেছন থেকে কেউ একজন হিরো আলমকে ধাক্কা দেন। পুলিশের উপস্থিতিতেই ধাক্কা দিতে দিতে তাকে ভোটকেন্দ্রের মাঠে আনা হয়। হিরো আলম নৌকার ব্যাজধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ জানান। তবে তাৎক্ষণিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এর পরই নৌকার ব্যাজধারীরা হিরো আলমকে ধাক্কা দিতে দিতে ভোটকেন্দ্রের ফটকের বাইরে বের করে আনেন। তখন তাকে দফায় দফায় পেটানো হয়। এ সময় হিরো আলমের সাথে থাকা সমর্থকদেরও ব্যাপক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে হিরো আলমকে লাথি মারেন একজন। পেটে লাথি খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান তিনি। পরে হিরো আলমকে ঘিরে নিয়ে আরো এক দফা পেটান নৌকার সমর্থকরা। তাকে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে মারতে ভোটকেন্দ্র থেকে গুলশানের দিকে প্রয় ২০০ মিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। একপর্যায়ে হামলা থেকে বাঁচতে দৌড় দেন তিনি। হামলাকারীরাও পিছু নেন তার। হিরো আলম পরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হাসপাতালে যান।

সন্ধ্যায় রাজধানীর রামপুরায় মহানগর প্রজেক্টের ‘ডি’ ব্লকের দুই নম্বর রোডে নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে হিরো আলম বলেন, এই সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। জীবনে আর কখনো নির্বাচন করব না। এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব না। নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।

চিত্রনায়ক ফারুকের (আকবর খান পাঠান) মৃত্যুতে শূন্য হয় ঢাকা-১৭ আসন। উপনির্বাচনে বিজয়ী মাত্র কয়েক মাসের জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন। কারণ আগামী বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আটজন প্রার্থী। স্বতন্ত্র হিরো আলম (একতারা) ছাড়াও উপনির্বাচনের অন্যান্য প্রার্থীরা হলেন, আওয়ামী লীগের মোহম্মদ আলী আরাফাত (নৌকা), জাতীয় পার্টির সিকদার আনিসুর রহমান (লাঙল), জাকের পার্টির কাজী মো. রাশিদুল হাসান (গোলাপ ফুল), তৃণমূল বিএনপির শেখ হাবিবুর রহমান (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো: রেজাউল ইসলাম স্বপন (ডাব) এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের মো: আকবর হোসেন (ছড়ি)। আরেক স্বতন্ত্র মো: তারেকুল ইসলাম ভূঞা (ট্রাক) দুপুরের দিকে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/763057/