২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৩

তামাকে বিনিয়োগ করে সরকার পুলকিত!

তামাকের করাল গ্রাস

বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি)। বাংলাদেশের মোট তামাক বাজারের অর্ধেকের বেশি এককভাবে কোম্পানিটির দখলে। বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে বিএটির মোট আয় ছিল ১৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৭৫৮ কোটি টাকা। দেশের সাধারণ নাগরিকদের অধিকাংশই জানেন না, বাংলাদেশ সরকার এমন জীবনবিনাশি বাণিজ্যে যুক্ত। বিএটিতে সরকারের বিনিয়োগ বর্তমানে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের ১০ সদস্যের মধ্যে ছয়জনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব। গত বছর কোম্পানিটি থেকে সরকার লাভ হিসেবে পেয়েছে ৮২ কোটি টাকারও বেশি। ভ্যাট-ট্যাক্স হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা তো আসছেই। স্বাভাবিক কারণে বিএটিতে করা বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের পুলকিত হওয়ারই কথা। যদিও খোদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিই এমন বাণিজ্যের তীব্র বিরোধী।
ইন্টার পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করা হবে। আবার সরকারই তামাক ব্যবসায় করছে। এ দেশে তামাকের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সবচেয়ে বড় বাধা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর একটা অংশের মালিক সরকার। সরকারের বড় বড় কর্তারা ওই কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্য।
এ অবস্থাকে পরস্পরবিরোধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করব সরকার অবিলম্বে তামাক ব্যবসায় থেকে ফিরে আসবে। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।
বিএটির জন্য শ্রমআইন শিথিল
তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর কিছু ধারা শিথিল করা হয়েছে। অন্য শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৪৮ হলেও নিজ শ্রমিকদের ৬০ কর্মঘণ্টা খাটাতে পারবে বিএটিবি। জনস্বার্থে শ্রম আইনের ১০০, ১০২, ১০৪, ১০৫ ও ১১৪ (১) নং বিধানের প্রয়োগ থেকে কোম্পানিটিকে অব্যাহতি দিয়ে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। বিএটিবিকে অব্যাহতি দেয়ার কাজটি জনস্বার্থে করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রজ্ঞাপনে। শ্রম আইনের ১০২ ধারা অনুযায়ী সপ্তাহে ৪৮ কর্মঘণ্টা নির্ধারিত থাকলেও এ প্রজ্ঞাপন বলে বিএটিবি শ্রমিককে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতে বাধ্য করতে পারবে। এ ছাড়া আইনের ১০৪ ধারা অনুযায়ী তিপূরণমূলক সাপ্তাহিক ছুটি (অর্থাৎ কোনো শ্রমিক তার প্রাপ্য ছুটি থেকে বঞ্চিত হলে উক্তরূপ ছুটির সমসংখ্যক ছুটি) প্রদানের বাধ্যবাধকতা এবং ১১৪ (১) ধারার (শিল্পপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দেড় দিন বন্ধ রাখার বিধান) প্রতিপালন হতেও কোম্পানিটিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে কোম্পানিটি প্রত্যেক শ্রমিককে পর্যায়ক্রমে সপ্তাহে মাত্র এক দিন ছুটি প্রদান করবে।
প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শ্রম আইনের ১০৫ ধারা অনুযায়ী একজন শ্রমিকের কর্মসময়ের সম্প্রসারণ আহার বিশ্রামের ১ ঘণ্টা বিরতিসহ দৈনিক সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টার বেশি না হওয়ার বিধানের প্রয়োগ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় আগ্রহী শ্রমিকদের দ্বিগুণ মজুরি প্রদান সাপেে অতিরিক্ত সময় কাজে নিয়োগ করা যাবে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৩২৪ এর উপধারা (১) ও উপধারা (২) এ প্রদত্ত মতাবলে শ্রম মন্ত্রণালয় ৬ মাস (২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে ১৭ মার্চ ২০১৭) এর জন্য কোম্পানিটিকে এ অব্যাহতি প্রদান করেছে মর্মে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
তামাকবিরোধীদের অভিযোগ, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে বছর বছর মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান প্রদান করে বিএটিবি। এ ছাড়া গত বছরের মার্চ মাস থেকে শ্রম সচিবকে বিএটিবির ইনডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসবের সূত্র ধরেই কোম্পানিটি এমন শ্রম স্বার্থবিরোধী অব্যাহতি পেয়ে থাকতে পারে বলে তাদের অনুমান। তামাক কোম্পানিকে এভাবে লাভবান করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুজুর ভয় : চোরাচালান
অনুসন্ধানে জানা যায়, তামাকপণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং বাড়তি করারোপ থেকে বিরত রাখতে খোদ সরকারের ভেতরের বিভিন্ন পক্ষ কাজ করছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেব কাজ করছে বিএটি। করারোপের মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়ালে চোরাচালান বাড়বে এবং সরকার বিপুল রাজস্ব হারাবেÑ এ অসত্য প্রচারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই ‘টার্গেটিং স্মাগলড সিগারেট’ প্রতিপাদ্যে ‘চোরাচালানকৃত সিগারেট প্রতিরোধ সপ্তাহ’ পালন করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তামাক কোম্পানিগুলো প্রতি বছর বাজেটের আগে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে করপ্রণেতা ও নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করে থাকে। কৌশল হিসেবে তামাক কোম্পানিগুলো জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কয়েক মাস আগে থেকে কৃত্রিমভাবে এ ধরনের চোরাচালানের ঘটনা বৃদ্ধি করে থাকে এবং এসব খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করে।
মিডিয়া মনিটরিং সূত্রে প্রাপ্ত ডাটা বিশ্লেষণ করে তামাক নিয়ে কাজ করা গবেষণা সংস্থা প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) জানায়, প্রতি বছরই বাজেট তৈরির কয়েক মাস আগে থেকে এ সংক্রান্ত খবরাখবর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। যদিও বছরের অন্যান্য সময়ে এ ধরনের খবর তেমন চোখে পড়ে না।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে তামাকপণ্যের চোরাচালান খুবই সামান্য। যেহেতু চোরাচালান একটি দেশের দুর্বল সীমান্ত/বন্দর ব্যবস্থাপনা ইঙ্গিত করে সেহেতু তামাক কোম্পানির ফাঁদে পা দিয়ে এ ধরনের সপ্তাহ পালন জনমনে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অবিলম্বে এ উদ্যোগ বন্ধের দাবিও জানান তারা। দাবি করেন, সরকার যাতে অবিলম্বে বিএটি থেকে তার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যথায় সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215481