১৮ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:৫৬

রোমের আগুন নিরোর বাঁশি আমাদের সরকার ও টিপাইমুখ বাঁধ

ড. মো. নূরুল আমিন

ইংরেজ কবি স্টেনলি লেইনপুলের কথা অনেকে জানেন। তিনি রাজনীতি করতেন না। তবে রাজনীতিকদের নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা ও অদক্ষতার জন্য তার লেখনির মাধ্যমে তাদের কষাঘাত করতে ভুলতেন না। সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে সারা যুক্তরাজ্যে অরাজকতা, অর্থনৈতিক সংকট ও স্বৈরাচারিতায় গোটা জাতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সরকার ছিল উপনিবেশবাদ সম্প্রসারণে ব্যস্ত; জনগণ নিরাপত্তাহীন। এই অবস্থায় তিনি একটি ব্যাঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির কয়েকটি ছত্র নিম্নরূপ :
“When movements move they let them move
When problems rage they let them rage
And thus ignore the spirit of the age”
অর্থাৎ যখন বিক্ষুব্ধ জনতা আন্দোলনে নামে
তারা নির্লিপ্ততার সাথে আন্দোলন চলতে দেয়।
যখন সমস্যার আগুনে দেশ পুড়তে থাকে
তারা এই পাড়া অব্যাহত রাখে
এভাবে যুগের ও জনগণের চাহিদাকে উপেক্ষা করে।

কথাগুলো মনে পড়ল আমাদের বর্তমান সরকারের অবস্থা থেকে। দেশ এখন প্রচ- রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চলছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, মান-সম্মান, সম্পত্তি কোনো কিছুরই নিরাপত্তা নেই। আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে মানুষের জীবন বিপন্ন। চাল-ডাল-আটা-চিনি থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি পণ্য সিন্ডিকেটের হাতে। তারা মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে খেলছেন। মন্ত্রীরা বলছেন, এদের বিরুদ্ধে তারা অসহায়, কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে দেশ অচল হয়ে পড়বে। তাহলে সরকার কেন? প্রায় পনের বছর ধরে দেশে অপশাসন চলছে। ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সরকার নির্লিপ্ত। বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও অন্যান্য দাবিতে এক দফার আন্দোলন ঘোষণা করেছেন। সরকারও একদফা ঘোষণা করেছেন, তা হচ্ছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন। দেশকে এভাবে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বৃহত্তর সিলেট ও উত্তরাঞ্চলে বন্যা চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হীন, অভুক্ত। সরকারি তৎপরতা নেই। পত্র-পত্রিকা ও টেলিভেশন চ্যানেলের এসব নিউজ আসা নিষেধ। মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের অবস্থা ‘সারা গায়ে ক্ষত, ওষুধ দেব কত’ এর মতো।

আমাদের সামনে সমস্যার এখন পাহাড়। এই পাহাড়ের মধ্য থেকে আজেেক আমি প্রায় ভুলে যাওয়া একটি সমস্যা ও তার সমাধানে সরকারি ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সমস্যাটি হচ্ছে টিপাই মুখ বাঁধ। এই বাঁধের কারণে আমরা ধ্বংস হচ্ছি, ভারতের সেভেন সিস্টার্সে হানাহানি শুরু হয়েছে।

এখন বিস্তারিতে আসি। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১১ সালে ঢাকা এসে টিপাইমুখ প্রকল্প তারা করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে দিল্লীতে গিয়েই তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। যেমন তিস্তার পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য তারা গজলডোবার বাঁধ নির্মাণ সমাপ্ত করেছেন।

টিপাইমুখ সম্পর্কে অনেকে পুরোপুরি অবহিত নন। তাই একটু ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।
টিপাইমুখ প্রকল্প : বর্ণনা ও প্রাসঙ্গিক কথা : টিপাইমুখ হচ্ছে মিজোরাম সীমান্তে মনিপুর রাজ্যের একটি অখ্যাত এলাকা। জাপভো পর্বতশৃঙ্গে উৎপন্ন হয়ে বরাক নদী টিপাইমুখে এসে সমতল ভূমিতে পড়েছে। বস্তুত, বরাক হচ্ছে গুমতি, হাওরা, কাগনি, সিনাইবুড়ি, হবিমঙ্গল, কাকরাই কুরুলিয়া, বালু ছড়ি, সোনাইছড়ি এবং দরদরিয়া প্রভৃতি স্রোতধারা সমৃদ্ধ একটি নদী, যা বাংলাদেশের মেঘনা নদীর উৎস। উৎসমুখ থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত বরাক নদীর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৫৬৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা এ দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে সুরমা এবং কুশিয়ারা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। ঐতিহাসিক তথ্যে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন (Central water Commission) টিপাইমুখ পয়েন্টে একটি বহুমুখী প্রকল্প প্রণয়নের সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনা করে এবং ১৯৭৪ সালে তারা সেখানে একটি ড্যাম তৈরির স্থান নির্ধারণ করে। ভারত সরকার এখানে একটি জলাধার তৈরির জন্যও প্রস্তুতি গ্রহণ করে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা। ভারত ১৯৮২ সালে যৌথ নদী কমিশনে এই প্রস্তাবটি পেশ করেছিল। বলাবাহুল্য, এ প্রকল্পের বিস্তারিত জরিপ পরিচালনার জন্য ভারত সরকার ১৯৮০ সালে ব্রহ্মপুত্র বোর্ড গঠন করে এবং ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ এবং জলবিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সময় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। এই সরকার ভারতের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেনি। এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতের North Eastern Electric Power Corporationকে (NEEPCO)। প্রকল্প দলিল অনুযায়ী টিপাইমুখ প্রকল্পের অধীনে ১৬২.৮ মিটার উঁচু এবং ৩৯০ মিটার লম্বা পাথরের একটি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এই বাঁধের উচ্চতা প্রশস্ততার অনুপাত হচ্ছে ১:২.৩৯। এই বাঁধের দু’টি উদ্দেশ্য। একটি হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ আর একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই প্রকল্পের অধীনে ভারত ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের কাপ্তাই প্রকল্পের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২৩০ মেগাওয়াট। টিপাইমুখে ভারত যে জলাধার তৈরি করছে তার আকার হচ্ছে ২৯৬.৫ বর্গকিলোমিটার এবং এই জলাধারের গভীরতা ১৬৩ মিটার।
বাংলাদেশের অবস্থান : টিপাইমুখ প্রকল্পের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনার আগে আমি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা জরুরি বলে মনে করছি। আগেই বলেছি টিপাইমুখ পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্যে সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব ১৯৮২ সালে ভারত যৌথ নদী কমিশনের নিকট পেশ করেছিল। তারও আগে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে টিপাইমুখ সম্পর্কে অবহিত হয়ে বাংলাদেশ সরকার যৌথ নদী কমিশনের বিভিন্ন সভায় ভারতের কাছ থেকে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করেছিল এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলীও চাওয়া হয়েছিল। (দেখুন, খলিলুর রহমান প্রণীত “Cooperation on Water Resources: Bangladesh Perspective”, Dhaka 2007) এ অবস্থায় ১৯৭৮ সালে যৌথ নদী কমিশনের সভায় টিপাইমুখ বাঁধের ওপর একটি যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তটি ভারতের অনীহার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীকালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৫তম ও ৩৬তম সভায় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনাকালে ভারতের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা ভারতের নেই। কাজেই টিপাইমুখ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো তথ্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও নেই। কিন্তু ভারতের এই আশ্বাস বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। ভারত সরকারের ওপর তাদের আস্থা ছিল না। এ অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত ভারতের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাটিতে ফুলেরতল নামক স্থানে ভারত সরকার একটি জলাধার নির্মাণ করতে চায়। কিন্তু টিপাইমুখ পয়েন্টে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা ফুলেরতল প্রকল্প সম্পর্কে নিশ্চুপ হয়ে যান। তারা কি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারণা থেকে সরে এসেছেন, না উভয় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রহস্যটির সুরাহা এখনো হয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন যে, টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ভারত ফুলেরতল প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে।
দ্বিতীয়ত : ১৯৮২ সালে ভারত যৌথ নদী কমিশনকে জানিয়েছিল যে, টিপাইমুখে তারা জলাধার নির্মাণ করবে এবং সংযোগ খালের মাধ্যমে এই পানি প্রত্যাহার করে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি করবে। বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে National Water Grid তৈরির বিশাল কর্মসূচি নিয়েছে টিপাইমুখ হচ্ছে তা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ।
অবশ্য রাষ্ট্রীয় অভিলাষ কখনো গোপন থাকে না। আগেই বলেছি ভারত সরকার টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন তথা নিপকোকে প্রদান করেছে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নিপকো প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের জন্য ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নিকট আবেদন পেশ করে। মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে প্রকল্পটির Environmental impact Assesment (EIA) পরিচালনার জন্য Agricultural finance corporation of Mumbaiকে দায়িত্ব প্রদান করে। ২০০৭ সালে তা তিন খন্ডের একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটিতে Environmental impact Assesment, Environmental Management Plan এবং Dam Break Analysis and Disaster Management সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলেও Damটি পরিচালনা এবং টারবাইনের সুইচ অন-অফ করার পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি যা পানির প্রবাহ নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুম্বাই এর এএফপি রিপোর্টে শুক্লা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফুলেরতলে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভারত বরাক নদীর ওপর শুধু টিপাইমুখেই বাঁধ দিচ্ছে না তার ভাটিতে ফুলেরতলেও বাঁধ দিচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে। “There is a proposal to constract a pick up barrage at fulertal, 95km down strem of dam site which will act as diurnal storage of 1120 cusce inclusive of power release to irrigate subsequently a gross command area of 120337 ha” টিপাইমুখে বাঁধ এবং বিশাল জলাধার নির্মাণ করে ভারত বরাকের দুই-তৃতীয়াংশ পানি আটকে রেখে সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার দিকে নিয়ে যাবার পরও ভাটির দিকে যৎসামান্য যে পানি আসবে ফুলেরতলে বাঁধ তৈরি ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সে পানিটুকুও তারা যে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে রিপোর্টে তারই কথা বলা হয়েছে। ফুলেরতলে দৈনিক ১১২০ কিউসেক পানির মজুদ সৃষ্টি ও ১২০৩৩৭ হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যে তা প্রত্যাহারের বিষয়টি বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত মারাত্মক। এই পানি প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশের নদীগুলো বিশেষ করে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা অববাহিকায়, কোন পানি পাওয়ার সম্ভাবনাই আর থাকবে না। এতে এই অববাহিকার জনসাধারণের জীবনে মারাত্মক দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, ফুলেরতলে বাঁধ না দিলে টিপাইমুখ প্রকল্প ভারতের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হবে না। রিপোর্টে এ আশঙ্কাও করা হয়েছে যে, কোন কারণে যদি টিপাইমুখ ড্যাম ব্যর্থ হয় বা তাতে ফাটল ধরে তাহলে এর ভাটিতে ৫.৫ মিটার উচ্চতায় বন্যা আঘাত হানবে এবং এর ফলে সন্নিহিত এলাকা এবং বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলও ভেসে যাবে।

সাড়ে ৫ মিটার উচ্চতার অর্থ হচ্ছে প্রায় বারো হাতের বেশি উচ্চতা। এখন ভেবে দেখুন এই উচ্চতায় যদি পানি আসে তাহলে আমাদের সিলেট এলাকার কয়টি বাড়ি-ঘর রক্ষা পাবে। EIP রিপোর্টে আর একটি তথ্য দেয়া হয়েছে এবং এই তথ্যটি হচ্ছে ভূমিকম্প সম্পর্কিত। রিপোর্ট অনুযায়ী টিপাইমুখ হচ্ছে ভারতের সিসমিক জোনিং ম্যাপের ৫ম জোনে অবস্থিত। প্রাপ্ত রেকর্ড অনুযায়ী এই অঞ্চলে ইতঃপূর্বে ৭ মাত্রারও বেশি পরিমাপের ১৬টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি ভূমিকম্প ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাত্রার, ৮.৫ মাত্রার বেশি। এ প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে এলাকাটি ভূমিকম্পের আশঙ্কামুক্ত নয় এবং যদি পুনরায় ভূমিকম্প হয় তাহলে এ বাঁধের অস্তিত্ব যেমন থাকবে না তেমনি মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড তো যাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্বও এ বাঁধ বিপন্ন করে তুলবে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, বিশেষজ্ঞদের এই আশঙ্কা সত্ত্বেও বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। বিষয়টি তারা না সংসদে আলোচনা করেছেন, না বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করছেন। বরং মন্ত্রীরা যেসব কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে যে, তাদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত নিয়েই ভারত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
টিপাইমুখ নিয়ে মণিপুর মিজোরাম নাগাল্যান্ডসহ ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যসমূহের মানুষ বিক্ষুব্ধ। তারা ঘর-বাড়ি, পেশা, জীবিকা ও পরিবেশ হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত। তাদের আতঙ্ক নিয়ে এ পর্যায়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা সমীচীন মনে করি না। আমি বাংলাদেশের ওপর এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই।

বাংলাদেশের ওপর টিপাইমুখের প্রভাব : টিপাইমুখ এবং ফুলেরতলে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণের ফলে ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যসমূহ ও বাংলাদেশের ওপর যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে তার মধ্যে কিছু আছে যা এক ও অভিন্ন। এর প্রথমই হচ্ছে প্রকল্পটি কারোর জন্যই নিরাপদ নয়। হয়তো এ প্রকল্প ভরাট ও সুরমা কুশিয়ারা মেঘনা অববাহিকায় জনসাধারণের জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলবে। এর ৩য় প্রতিক্রিয়া হবে পরিবেশ বিপর্যয় এবং সর্বশেষ উত্তর-পূর্ব ভারতের একই ধরনের ড্যামের ন্যায় এই ড্যামটিরও ব্যর্থতা মানুষের জীবন ও সম্পত্তির জন্য সর্বদাই হুমকি হয়ে থাকবে। এই হুমকি শুধু ভারতের সীমানার মধ্যে সীমিত থাকবে না, তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলকেও সর্বদা তটস্থ রাখবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অভিন্ন নদী সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গত ৬০ বছর ধরে যে বিরোধ চলে আসছে তার সমাপ্তি ঘটবে না। ভারত মরিয়া হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি প্রত্যাহারের চেষ্টা করছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে ১৫০০০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে যার মাত্র ২১ শতাংশ তারা উৎপাদন করতে পারছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত সরকার এ উৎপাদনের মাত্রা ৩১ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের বিবেচনা অনুযায়ী উত্তর-পূর্ব ভারতে ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা রয়েছে। এ সম্ভাব্যতাকে কাজে লাগানোর জন্য তারা পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র বোর্ড সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ভারত এই অঞ্চলে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দিহাং, সুবাংসিড়ি, লহিতা, জাদুকাটা, সোমেশ্বরী, ভৈরবী, নোয়াদিহিং এবং কুলশীতে ৮টি হাইড্রোইলেকট্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য তারা ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও বরাকের উজানে বাঁধ দিচ্ছে। ফলে বৃহত্তর সিলেটসহ বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে নদী তার নাব্যতা হারাবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাবে এবং আর্সেনিক ও লবণাক্ততার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাবে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার রজার্স উত্তর-পূর্ব ভারতে জলাধার নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ওপর তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন। (Eastern water study) এই সমীক্ষা অনুযায়ী বর্ষা মওসুমে এই বাঁধের ফলে বাংলাদেশের বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। আবার টিপাইমুখ বাঁধ বাস্তবায়িত হবার পর বরাক নদীর পানিতে দু’টি গুণগত পরিবর্তন আসবে। প্রথমত ড্যাম থেকে যে পানি ছাড়া হবে তা হবে উষ্ণ এবং এই উষ্ণ পানি মৎস্য প্রজাতির জন্য ক্ষতিকর। যে সমস্ত মাছ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সমতল ভূমিতে এবং সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে আসা-যাওয়া করে তারা তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারাবে। ফলে বরাক তথা সুরমা কুশিয়ারা মৎস্যশূন্য হয়ে পড়বে। প্রকল্প দলিলে যদিও Fish Ladder স্থাপনের কথা বলা হয়েছে তথাপি দুনিয়ার কোথাও তার কার্যকারিতা দেখা যায়নি।

টিপাইমুখ ড্যামে টারবাইন চালু থাকবে। ফলে সেখান থেকে যে পানি নীচের দিকে ছাড়া হবে তা হবে পলিমুক্ত। পলিমুক্ত পানি হচ্ছে কৃষি ও বনায়নের জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। এই পানির চলাচল ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি এবং স্রোতের বেগ দ্রুততর। এর ফলে নদীর তলদেশ যেমন গভীর হতে পারে তেমনি দু’পাড় ভাঙার গতিও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের মাটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এঁটেল, দোআঁশ ও পলিযুক্ত। স্বচ্ছ পানির তীব্র স্রোতে এই মাটি ভেঙে যাওয়া অত্যন্ত সহজ। এর ফলে জনবসতি ও কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার আমাদের কৃষিজমির অন্যতম উৎস হচ্ছে পলিমাটি। উজান থেকে পলি বন্ধ হয়ে গেলে ভাটির দিকে আমাদের জমি-জমা উর্বরতা যেমন হারিয়ে ফেলবে, তেমনি বালি ও নুড়িপাথর থেকেও আমরা বঞ্চিত হব। ফলে শুধু কৃষি ও মৎস্যজীবীরা নয় নির্মাণ সামগ্রীর সংগ্রহ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ লোক তাদের পেশা ও কর্মসংস্থান হারাবে। খনিজ সামগ্রী বাবত লোকসান তো রয়েছেই।

ভূমিকম্পের দরুন সৃষ্ট সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা আমি আগেই বলেছি। এই বিপর্যয় ছাড়া ড্যামের আরেকটি বড় হুমকি হচ্ছে অতি বৃষ্টির ফলে ড্যামের ওপর দিয়ে পানি উপচে পড়ার সম্ভাবনা। এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। ১৯১৭ সালে মধ্য প্রদেশের টিগরা ড্যাম ওভারটপিংয়ের কারণে বিধ্বস্ত হয়ে ১০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে মধ্য প্রদেশের কদম ড্যাম, ১৯৫৯ সালে গুজরাটের কারলা ড্যাম, ১৯৬০ সালে মহারাষ্ট্রের পানসেট ড্যাম, ১৯৬৭ সালে পাঞ্জাবের নানক সাগর ড্যাম এবং ১৯৭৯ সালে গুজরাটের মাচ্চু-২ ড্যাম ওভারটপিংয়ের কারণে বিধ্বংস হয়ে হাজার হাজার লোকের প্রাণহানির কারণ ঘটিয়েছিল। আবার ১৯৭৫ সালে অতিবৃষ্টির ফলে চীনের হুনান প্রদেশের বানকিয়াও ড্যাম বিধ্বস্ত হয়। ফলে জলাধারের পানি ১০ মাইল প্রশস্ততা ও ৭ মিটার উচ্চতা নিয়ে ৫০ মাইল বেগে ৫টি অঞ্চলকে আঘাত হানে। এতে তাৎক্ষাণিকভাবে ২৬০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে এবং ১৪৫০০০ লোক বন্যার তোড়ে ভেসে যায়। ফলে নিহতদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭১০০০ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ কোটি ১০ লাখ পরিবার। এই দুর্ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যদি টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ড্যামে বিপর্যয় ঘটে, তাহলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল লাশের সমুদ্রে পরিণত হবে। তারা হবে ভারতের সস্তা বিদ্যুতের বলি।
টিপাইমুখ বাঁধের ফলে বাংলাদেশের ৪০ ভাগ অঞ্চল মরুভূমি হওয়া ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা এবং ময়মনসিংহ-এর হাওড়সমূহও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং আমরা আমাদের জীববৈচিত্র্য হারাবো।

উপরোক্ত অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা। তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনেক করেছেন কিন্তু তা কাজে আসেনি। বরাক নদীর উৎস ভারত হলেও যেহেতু নদীটি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা কুশিয়ারা ও মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, সেহেতু এটি সম্পূর্ণভাবেই একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীতে বাঁধ দেয়া এবং তার পানি প্রত্যাহার করার বিষয়টি কখনো ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাটির দেশকে ভারত বঞ্চিত করতে পারে না। UN Convention of 1997 on water use এবং Helsinki Ruls তারা মেনে চলতে বাধ্য। যাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, উজানের দেশ ভাটির দেশকে পানি থেকে যেমন বঞ্চিত করতে পারে না তেমনি তাকে অন্ধকারে রেখে নদীর প্রবাহ রোধ অথবা পানি প্রত্যাহারের অধিকারও তার নেই। এই অবস্থায় বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন সময়ের দাবি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা করেনি। এখনো সময় আছে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে তৎপর হওয়া অপরিহার্য।

https://dailysangram.info/post/530222