১৭ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ৮:৫৬

পরিস্থিতি ভয়াবহ

সর্বত্র ডেঙ্গুর আগ্রাসন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় হিসাব পাল্টে যাচ্ছে। ওয়ার্ডের বাইরে খোলা জায়গায় চলাচলের পথে, সিঁড়ি ও লিফটের আশপাশে রোগীর শয্যার ব্যবস্থা করেও কুল পাচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের স্টাফ ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অতিরিক্ত চিকিৎসক-নার্স দিয়ে রোগী সামাল দেয়া যাচ্ছে না। রোগী ও তাদের স্বজনরাও আক্রান্তদের নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছেন না। শয্যা সংকট থাকার পরও তারা হাসপাতাল ছাড়তে চান না।

ঢাকার দুই সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা হাসপাতালেই গত দুই মাসে ৫২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৯৩ জন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ডেঙ্গু ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করেছে।

সচেতনতা না বাড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর হাসপাতালটিতে মোট ১ হাজার ৫১৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ৯৪৩ জন পুরুষ ও ৫৭৪ জন নারী। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৯৩৪ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি গেছেন। সুস্থ না হয়েও নিজে থেকে ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩০৬ জন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩ জন রোগী। এর মধ্যে ১১ জন পুরুষ ও ১২ জন নারী রোগী। মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ১৯ জনই জুন ও জুলাই মাসে মারা যান। আর বাকি ৪ জনের মধ্যে এপ্রিল ও মার্চে ২ জন করে ৪ জন। হাসপাতালটি বলছে, ভর্তি দেড় হাজার রোগীর মধ্যে শেষ ৩ মাসে ১ হাজার ৪৩৯ জন ভর্তি হয়েছেন। তারমধ্যে মে মাসে ১১৪ জন, জুনে ৫৮৫ জন ও চলতি মাসের জুলাই ১৬ তারিখ পর্যন্ত ৭৪০ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২৭ জন। ছাড়পত্র নিয়েছেন ৫৮ জন। এখন ভর্তি আছেন ২৫৪ জন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১৭১ জন। হাসপাতালের আইসিইউতে ক্রিটিক্যাল রোগী আছেন ৫ জন।

মুগদা হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালের সব বিভাগ মিলিয়ে রোগী ভর্তি আছে ১ হাজার ২১৬ জন। আর শুধুমাত্র মেডিসিন বিভাগে ডেঙ্গু রোগী আছেন ৫০৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬০ জন। গুরুতর শারীরিক অবস্থার ৮ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। হাসপাতালটিতে জুন ও চলতি মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৯ জন। এরমধ্যে জুন মাসে ১৫ জন ও জুলাই ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১৪ জন।

মুগদা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমরা রোগী সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। ৫০০ শয্যার হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি আছে ৫০৩ জন। এ ছাড়া অন্যান্য বিভাগে আরও ৭০০ রোগী ভর্তি আছেন। ডেঙ্গু রোগীদের সেবার জন্য ১১ জন চিকিৎসক ও ১৬ জন নার্স বাহির থেকে এসেছেন। নিয়মিত ও বাহির থেকে আসা চিকিৎসক-নার্স দিয়ে রোস্টার তৈরি করে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ হচ্ছে সতর্কতার কোনো বিকল্প নাই।
প্রতি ঘণ্টায় ২ জন করে রোগী আসছে

প্রথমে হালকা জ্বর ছিল। ২ দিন পার হলেও জ্বর কমছিল না। দেখলাম ওষুধে কাজ করছে না। রাতে জ্বর আরও বেড়ে যায়। সকালে দ্রুত হাসপাতালে আসি। এসেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করি। রিপোর্ট পজেটিভ আসে। ডাক্তার হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে ভর্তি করে নেয়। ভর্তির পরদিন ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। শরীর প্রচুর ঘামছিল। অবশ হয়ে আসছিল। যেন দম যায় যায় অবস্থা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। প্লাটিলেট ১১ হাজারের নিচে নেমে যায়। পরিবারের লোকজন আমার পাশেই ছিল। তাদের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হচ্ছিলো বাঁচবো না। কিন্তু দুপুরে আস্তে আস্তে শরীরের ব্যথা কমে আসে। একটু হালকা লাগলো। তখন মনে হলো বেঁচে গেছি। মরতে মরতে বেঁচে গেছি। আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া। তবে ডাক্তারদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬ দিন সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি সারোয়ার হোসেন এমন কথা বলছিলেন। সারোয়ার আরও বলেন, ২ বছর মোহাম্মদপুরের নবোদয় এলাকায় থাকি। এখানে মশার উপদ্রব বেশি। বারো মাসই মশা থাকে। নবোদয় খালে মশার অভাব নেই। এই মশাই রাতে আশপাশের বাসাবাড়িতে যায়। তবে সিটি করপোরেশন কখনো মশা মারতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ওখান থেকেই আশপাশের ডেঙ্গুর বিস্তার হচ্ছে। দেখার কেউ নাই।

সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালের চতুর্থ তলায় শিশু ওয়ার্ডে ৪ দিন ধরে ভর্তি আছে শিশু নাহিদুল। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বমি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করালে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। তখন থেকেই শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে নাহিদুল। কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে উঠছে। স্যালাইন চলছে। হাতে ক্যানোলা পরানো আছে। ডাক্তার দেখলেই ভয় পায়। চিকিৎসার ৪ দিনেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। নাহিদুলের বাবা নাঈম খান মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, বাচ্চার ডেঙ্গু হয়েছে।

ভেবেছিলাম ঠাণ্ডাজনিত জ্বর হবে। কিন্তু বমি ও শ্বাসকষ্ট দেখে সন্দেহ হয়। পরে হাসপাতালে আনি। পরীক্ষা করে দেখি ডেঙ্গু হয়েছে। অনেক চিন্তায় আছি। আশপাশে অনেক খারাপ খবর শোনা যাচ্ছে। ছেলে দ্রুত সুস্থ হলেই স্বস্তি মিলবে। আল্লাহ’র কাছে ছেলের সুস্থতা কামনা করছি। আর হাসপাতালের পরিবেশ বেশ ভালোই। তবে খাবারে একটু সমস্যা আছে। খাবার বেশি ভালো না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা গাবতলী এলাকায় থাকি। আমি কখনো দেখিনি সিটি করপোরেশন আমাদের এলাকায় কখনো মশার ওষুধ দিয়েছে। তারা শুধু মেইন রাস্তা দিয়ে স্প্রে করে চলে যায়। মাঝেমধ্যে গলিতে ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দেয়া হয়। কিন্তু ওতে মশা মরে না। গাবতলী এলাকায় প্রচুর মশা। বেশি মানুষের বসবাস। কিছু জায়গায় পানি জমে আছে। সেখানে মশার অভাব নেই। এই মশা রাতে বাসাবাড়িতে যায়। শুনেছি এলাকার আরও অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে।

সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত একমাসে ৩ ওয়ার্ডে মোট ৩৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৩৮ জন। মারা গেছে ১ জন। এখনো নারী, পুরুষ ও শিশু ভর্তি আছেন ১২০ জন। তারা সবাই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে আগের তুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ও ভর্তি সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নারী, পুরুষ শিশুসহ ভর্তি হয়েছে মোট ৪৫ জন। এতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় হাসপাতালের চাপও বেড়েছে। সিট সংকট দেখা দিয়েছে। গত ২৮ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে ১০ জন। তবে ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা যায়নি।

সরজমিন সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালের ৬ তলার কার্ডিওলোজি বিভাগের ভেতর নারী ও পুরুষ ৩টি পৃথক ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। ওয়ার্ড ৩টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। পরিবেশও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রতি ওয়ার্ডে ১ জন ডাক্তার ও ৪ জন নার্স সেবা দিচ্ছেন। রোগীর সঙ্গে স্বজনরাও খাবার পাচ্ছেন। তবে হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে সিট সংকট থাকলেও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। করা হয়েছে একাধিক ইউনিট। হাসপাতালের মেঝেতে কোনো ডেঙ্গু রোগীকে রাখা হয়নি। সবাই সিট পাচ্ছেন। সেবা নিয়ে রোগীদের মাঝেও তেমন কোনো অভিযোগ দেখা যায়নি।

রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন। তবে খাবারের মান নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। খাবার ভালো না হওয়ায় অনেকে হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে খাবার এনে খাচ্ছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড করা হয়নি। তবে ৩ তলায় সাধারণ শিশু ওয়ার্ডের পাশেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ইউনিট করা হয়ছে। ৬ তলার নারী-পুরুষ দুই ওয়ার্ডে প্রায় ১২০টি আসন (বেড) আছে। সব বেডেই এখন রোগী ভর্তি। এখন নতুন ডেঙ্গু রোগীদের ওই বিভাগের অন্যান্য খালি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। এরপরও রোগীর চাপ থাকায় যেখানেই বেড খালি হচ্ছে। সেখানেই ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নির্ধারিত বেডে আনা হচ্ছে। বর্তমানে শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে ৩৫৯ ডেঙ্গু রোগী।

চিকিৎসাসেবার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মুরসালিন রাজু (৩০) জানান, সরকারি হাসপাতাল অপরিষ্কার থাকে। কিন্তু এখানে বেশ পরিষ্কার দেখছি। শুধু ডেঙ্গু ওয়ার্ডে এসি দেয়া আছে। বার বার পরিষ্কার করা হচ্ছে। ডাক্তাররাও প্রতি ঘণ্টায় আসছেন। রোগীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। আর ৩ থেকে ৪ জন নার্স সবসময়ই আছেন। সেবা দেখে ভালোই লাগছে।

শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খলিলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমরা ডেঙ্গু রোগীদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেবা দিচ্ছি। তাদের জন্য বেশ কয়েকটি নতুন ওয়ার্ড চালু করেছি। অনেকে রিকভার হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। আমাদের এখানে মৃত্যু শূন্য বলতে পারেন। কারণ গত দেড় মাসে মাত্র ১ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি শিশুদের বেশির ভাগই শক সিনড্রোমে আছে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে থাকাদের সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়। কখনো কখনো শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। এ ছাড়া কারও কারও ত্বক শীতল হয়ে আসে। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপরে লাল ছোপ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও আরও নানা উপসর্গ দেখা দেয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার কারণেই মৃত্যু হয়।
হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণা নিয়ে আলোচনা

দেশে উদ্বেগজনক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর আসছে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা জারির বিষয়ে সরকার পর্যালোচনা করছে। কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠছে। এতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চ্যুয়াল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানিয়েছেন, চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা জারির বিষয়ে সরকার পর্যালোচনা করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণার সময় এখনো আসেনি। তবে কোভিডের সময় আমরা পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি করেছি। এবারো নিশ্চয়ই সেটি হতে পারে। এটি পলিসি লেভেলের বিষয়। আমরা আমাদের কনসার্ন পলিসি লেভেলে জানিয়েছি। এরপর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ডেঙ্গুর এখন যে পরিস্থিতি সেটি ইমার্জেন্সি জারির মতো কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত। আমরা এটি এনালাইসিস করে দেখছি।

কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত খরচ বিষয়ে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেও সতর্ক থাকতে হবে। গতকাল দেশের চলমান ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় ঢাকায় সব হাসপাতালের প্রিপারেশন দেখতে হবে।

রোগীদের যেন বেশি ব্যয় না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে দেরি করলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে আজই একটি নোটিশ জারি করতে হবে। আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, আমরা চাই সরকারি হাসপাতালেই যেন ডেঙ্গু রোগীরা ভর্তি হন এবং চিকিৎসাসেবা নেন। কিন্তু কেউ যদি নিজ ইচ্ছায় বেসরকারি হাসপাতালে যেতে চায়, যেতে পারেন। তবে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের ভালো চিকিৎসা দেয়া হয়। পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি বা জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ের নামে রোগীর ‘গলাকাটা’ হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণে মনিটরিং টিম করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম জানান।

স্বাস্থ্যের ডিজি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত ফি নেবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। তবে বেড ভাড়া এবং অন্যান্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে চার্জ নির্ধারণ করা হয়নি। আমরা শনিবার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শিগগিরই কয়েকটি হাসপাতাল পরিদর্শন করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপরে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তিনি জানান, মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য শয্যা সংখ্যা ৫০০টি। কিন্তু সেখানে রোগী ভর্তি আছেন ৬০০ জনের মতো। বোঝাই যাচ্ছে, শয্যা না পাওয়া ডেঙ্গু রোগীরা কীভাবে সেখানে আছেন! আমরা অতিরিক্ত কিছু শয্যার ব্যবস্থা সেখানে করেছি। সে অনুযায়ী যথাসাধ্য চিকিৎসাসেবা দিতে চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্যের ডিজি আরও বলেন, মুগদা হাসপাতালের আশপাশের জোনগুলো যেমন শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, কদমতলি, বাসাবো, মুগদা থেকে শুরু করে রামপুরা পর্যন্ত পুরো এলাকাতেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।

ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ১০৬, হাসপাতালে ভর্তি প্রায় ২১ হাজার: প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুতে রেকর্ড হচ্ছে। ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪২৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জুলাই মাসের ১৬ দিনে ৫৯ জনের প্রাণহানি এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ১২ হাজার ৯০০ জনে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৬ জনে। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ২৪ জন। সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৪২৪ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৪১ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৮৩ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ১ হাজার ৪২৪ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৫৫ জনে। ঢাকার ৫৩টি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ১৫৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৮০১ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৮৭৮ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ হাজার ৮১৭ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাই মাসে শনাক্ত ১২ হাজার ৯০০ জন এবং মারা গেছেন ৫৯ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

 

https://mzamin.com/news.php?news=65015