১৭ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ৮:৫৪

আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি

বাড়তি টাকা খরচ ছাড়াই শিক্ষা জাতীয়করণ সম্ভব

‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা জাতীয়করণ হলে সরকারের এক টাকাও বাড়তি খরচ হবে না। বর্তমানে এমপিও হিসাবে দেওয়া অনুদানের অর্থেই ব্যয় সংকুলান হবে। এর সঙ্গে কেবল প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় যোগ করতে হবে। এই দুই অর্থ মিলিয়ে শিক্ষকের বেতনভাতা সবই দেওয়া যাবে। এরপরও বছরে অন্তত দেড়শ কোটি টাকার মতো সরকারের তহবিলে জমা থেকে যাবে।’

এমন দাবি করেছেন শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকরা। ১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন তারা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) ব্যানারে চলা এই কর্মসূচি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট নাগরিক দরকার। আর সেই স্মার্ট নাগরিক গড়ার জন্য আগে স্মার্ট শিক্ষক লাগবে। সেজন্যই শিক্ষা জাতীয়করণ জরুরি। এটা হলে বাড়তি লাভ হবে শিক্ষার মানের। তখন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। নিয়োগ পাবে আরও মানসম্মত শিক্ষক। ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং অসৎ শিক্ষকদের অন্যায়-অনিয়ম বন্ধ হবে। আর এর সুফল পড়বে শিক্ষায়। ফলে গড়ে উঠবে সুনাগরিক।’
সরকার সর্বশেষ ২০১৫ সালে জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা করে। সরকারি চাকরিজীবীদের মতোই শিক্ষকরা পে-স্কেলে শতভাগ বেতন পাচ্ছেন। অবসর ভাতাও আলাদা হিসাবে পাচ্ছেন। তবে তারা বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা অনুরূপ পাচ্ছেন না। শিক্ষক নেতাদের দাবি, যেসব খাতে ভাতা দেওয়া হয় না তার পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি নয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্র বেতন, ভর্তি ফি, সেশন চার্জবাবদ বিপুল অর্থ আদায় করে থাকে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের স্থাবর সম্পত্তি থেকেও আয় আছে। ওই আয় রাজকোষে নিলেই ব্যয়ের সংস্থান হবে।

তারা জানান, বর্তমানে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ১ কোটি ৬৩ লাখ শিক্ষার্থী আছে। প্রতি শিক্ষার্থী মাসিক ২০ টাকা হিসাবে টিউশন ফি দিলে বার্ষিক আয় হবে ৩৯০ কোটি টাকা। ভর্তি বা সেশন ফি বাবদ শিক্ষার্থীপ্রতি গড়ে ৪শ টাকা আদায় সম্ভব। এতে বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ৬৫০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের স্থাবর সম্পত্তি থেকে অন্তত ২০০ কোটি টাকা বছরে আয় করা সম্ভব। অন্যদিকে সরকার বর্তমানে এমপিও বাবদ বার্ষিক দেয় ১৪২৫ কোটি টাকা। এই তিন খাতের অর্থ একত্র করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু জাতীয়করণ করা হলে সরকারের বার্ষিক লাগবে ২৫০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে বার্ষিক উদ্বৃত্ত থাকবে ১৬৫ কোটি টাকা। এছাড়া প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে গড়ে সাধারণ ফান্ডে জমা আছে এক লাখ টাকা হিসাবে ৪০০ কোটি টাকা। সরকারি করা হলে এই অর্থও সরকারি তহবিলে জমা হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সব স্থাবর সম্পত্তিও সরকারের অনুকূলে যাবে।

শিক্ষক নেতারা আরও জানান, বর্তমানে সরকারি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী বেতন ১২ টাকা, নবম থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত ১৮ টাকা আর একাদশ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ২৫ টাকা। গড় বেতন ১৫ টাকা। জাতীয়করণ করা হলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ টাকা এবং নবম-দশম পর্যন্ত ৭৫ টাকা আর একাদশ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত বেতন ১০০ টাকা করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীপ্রতি গড় টিউশন ফি দাঁড়ায় মাসে ৭৫ টাকা। ফলে আয় আরও বাড়ানো সম্ভব।

এ কথার সমর্থন মেলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের। এতে কেবল শিক্ষক নয়, গোটা শিক্ষা উপকৃত হবে। শিক্ষায় বৈষম্য কমবে। মেধাবীরা আসবে শিক্ষকতায়। শিক্ষার মানের ব্যাপারে অভিযোগ লাঘব হবে। তাই এই দাবি যুক্তিসঙ্গত। তিনি আরও বলেন, আমাদের বর্তমানে যে জাতীয় অর্থনীতি এবং মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে তাতে শিক্ষকদের দাবি পূরণ কোনো ব্যাপারই নয়। উপরন্তু টিউশন ফি সবার জন্য ১শ টাকা করা হলে এ খাতে বরং যে উদ্বৃত্ত থাকবে তাতে শিক্ষকদের অবসরের ভাতাও ঠিকমতো দেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া আজকে ঘোষণা করলেই কাল শিক্ষকদের সরকারি স্কেলে বেতনভাতা দিতে হবে না। টাস্কফোর্স গঠন করে দিলে তারা প্রতিষ্ঠান বাছাই করবে। নীতিমালা নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা যায়। এতে কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ পড়বে। তারা আবার শর্ত পূরণ করার জন্য বাদ পড়া প্রতিষ্ঠান ফলাফল ভালো করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। ফলে পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মান উন্নত হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলনের সুরাহা করা যেতে পারে। আমি মনে করি, শিক্ষকদের স্থান রাস্তা নয়, ক্লাসরুমে।

এদিকে জাতীয়করণের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিরও নেতিবাচক ধারণা নেই বলে জানা গেছে। গত ৩ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’ প্রকাশ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বেড়েছে কিনা তা যাচাই করে জাতীয়করণে সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত। দেশের এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে হয় না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/696757/