১৭ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ৮:৫২

রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রভাব সারা দেশে

সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগে যাত্রীরা

২৫টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, কাটিয়ে উঠতে ২-৩ দিন লাগবে

শাহবাগে রোববার সড়ক অবরোধ করে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকদের বিক্ষোভ -যুগান্তর
শিক্ষক, চিকিৎসক ও রেল শ্রমিকদের আন্দোলনে রোববার রাজধানী ঢাকা অচল হয়ে পড়েছিল। লাগাতার আন্দোলনে সৃষ্ট যানজটে নগরবাসী চরম ভোগান্তিতে পড়েন। তবে এ তিন আন্দোলনে শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশে প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে সারা দেশে রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। ২৫টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে।

মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষকরা কর্মসূচি পালন করেন। এতে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান-মতিঝিল থেকে শুরু করে শহরের অন্যসব স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ভাতা বাড়ানোর দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পোস্টগ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকরা শাহবাগ মোড় দখল করেন। তাদের আন্দোলনে মৎস্যভবন, ফার্মগেট, ধানমন্ডি-এলিফ্যান্ট রোড-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা স্থবির হয়ে পড়ে। রেল শ্রমিকরা প্রথমে কাওরান বাজারের সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি শুরু করেন। পরে তারা রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বেলা ৩টার পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। ততক্ষণে ২৫টি ট্রেনের শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকদের অবস্থান : মঙ্গলবার থেকে শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় সারা দেশ থেকে তারা শনিবার রাতে ঢাকায় আসেন। রোববার সকালে তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের উত্তর গেটে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারী বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক এবং রাজধানীর সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের বিকল্প নেই। এজন্য লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চলছে। দাবি আদায় না করে তারা ঘরে ফিরে যাবেন না। তিনি আরও জানান, কয়েক মাস ধরে উপজেলা-জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। ৬ দিন ধরে রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে শিক্ষকরা অবস্থান নিলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কেউ ফিরেও তাকায়নি।

শাহবাগে প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের অবস্থান : পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাতা বাড়ানোর দাবিতে রোববার কয়েক হাজার পোস্টগ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক (প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক) প্রথমে জাতীয় জাদুঘরের সামনে যান। কিন্তু সেখান থেকে তাদের পুলিশ সরিয়ে দেয়। এরপর ক্যাম্পাসের বটতলায়ও তাদের অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন। এর ফলে শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাব মোড় পর্যন্ত সড়কের একপাশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

চিকিৎসকরা যুগান্তরকে জানান, তারা ভাতা হিসাবে মাত্র ২০ হাজার টাকা পান। এ দুর্মূল্যের বাজারে ভাতা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়াতে নীতিনির্ধারকদের একাধিকবার বলেছেন। বিভিন্ন সময় আশ্বাসও পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে। দাবি আদায় না হলে শাহবাগে লাগাতার অবস্থান চলবে।
আন্দোলনরত চিকিৎসক ডা. তৌহিদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ভাতা বাড়ানোর জন্য শান্তিপূর্ণভাবে দাবি করে আসছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছি। বারবার আশ্বাস দিয়েও তা মেনে নেওয়া হয়নি।

এদিকে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেছেন, পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানোর দাবির সঙ্গে বিএমএ একমত। তবে এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। রোববার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। ধারাবাহিক কর্মসূচির সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিএমএর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে তারা কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে তার সহকারীকে দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখবেন। কিন্তু তারা কারও কথা না শুনে নিয়মিত রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করছেন। এ সময় বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের ভাতার টাকা সরকার থেকে আসে। সরকার টাকা দিলে আমরা তাদের দিয়ে দেই। সরকারের কাছে ভাতা বাড়ানোর জন্য আমরাও বলেছি। সরকার পর্যবেক্ষণ করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। সবকিছুর জন্য সময় লাগে। কিন্তু তারা তা মানছেন না।

রেল শ্রমিকদের আন্দোলন : ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে অস্থায়ী শ্রমিকবৃন্দ’ নামে রেল শ্রমিকরা সকাল ৯টার দিকে কাওরান বাজার এলাকায় রেললাইনে অবস্থান নিয়ে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন। এ লাইন দিয়ে কোনো ট্রেন যেতে দেওয়া হয়নি। শত শত শ্রমিক রেললাইনে অবস্থান নেন। কারও কারও মাথায় কাফনের কাপড়, কারও কারও মাথায় লাল কাপড় প্যাঁচানো ছিল। দাবি আদায়ে তারা লাইনে শুয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীরা জানান, সারা দেশে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার।

রেল শ্রমিক আন্দোলনে কমলাপুর, বিমানবন্দর স্টেশনসহ বিভিন্ন স্টেশনে আন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেন আটকা পড়ে। অনেক যাত্রী টিকিট ফেরত দিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। চট্টগ্রামগামী যাত্রী জিন্নাত-আরা-জাহান জানান, অবরোধের কারণে শত শত যাত্রী দুর্ভোগে পড়েছেন। দাবি ন্যায্য হলে তা কেন সুরাহা করা হয় না। তিনি বলেন, যুদ্ধ করে টিকিট কেটে এখন ফেরত দিতে হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীরা কেন দুর্ভোগ পোহাবে।

রেলপথ ছেড়ে রেল ভবনে এসে কথা বলার জন্য আন্দোলনকারীদের অনুরোধ জানান পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন, ঢাকা রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সফিকুর রহমানসহ ১০ কর্মকর্তা। বেলা ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে দুই শতাধিক আন্দোলনকারী হেঁটে কাওরান বাজার থেকে রেলভবনের দিকে রওয়ানা দেন। রেল কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে হেঁটে রেলভবনে যান। এ সময় জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনকারীরা আমাদেরই লোক। দাবি আদায়ে তারা অবরোধ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে-কোনো অবস্থাতেই যেন তাদের ওপর আঘাত করা না হয়। বিকাল ৪টার পর তারা রেলভবনে আলোচনায় বসেন। এ সময় রেলপথ সচিব, রেলওয়ে মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনকারী শ্রমিকরা জানান, প্রায় দুই যুগ আগে রেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮-২০ বছর ধরে অনেকে রেলে চাকরি করছেন। চুক্তি অনুযায়ী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে তাদের চাকরি স্থায়ী করার কথা। চাকরি স্থায়ীকরণে কয়েক বছর ধরে রেলপথমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে রেলপথ অবরোধ করছেন। তারা আরও বলেন, সম্প্রতি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চাকরি স্থায়ী না করে বরং তাদের বাদ দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নতুন করে কর্মচারী নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকরা আরও জানান, আউটসোর্সিং কোম্পানির হয়ে তারা কাজ করতে চান না। তাদের চাকরি স্থায়ী করতে হবে।

জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বলেন, আউটসোর্সিং কোম্পানির টেন্ডার ডকুমেন্টে আমরা শর্ত দিয়েছি-আমরা অভিজ্ঞ লোক চাই। আপনারা যারা আন্দোলন করছেন তাদের আমরা অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দেব। একই সঙ্গে আমরা আউটসোর্সিং কোম্পানিকে বলব যেন আপনাদের তারা নিয়োগ দেয়। কারণ তাদের বিকল্প নেই।

পুলিশের এডিসি হাফিজ আল ফারুক জানান, আপনাদের (আন্দোলনকারী) সঙ্গে কথা বলতে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জিএম এখানে এসেছেন। রেলে আউটসোর্সিংয়ে লোকবল নিয়োগের সময় অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। যারা অস্থায়ীভাবে চাকরি করতেন তাদের অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের অফিসে বসে করতে হবে। এটা রেললাইনে বসে করার জিনিস নয়।

ঢাকা রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির যুগান্তরকে জানান, সকাল ৯টার পর থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত কমলাপুর থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি বা কমলাপুরে কোনো ট্রেন প্রবেশ করেনি। এ সময় আন্তঃনগর এবং কমিউটার ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে। একতা, কিশোরগঞ্জ, জয়ন্তিকা, অগ্নিবীণা, মোহনগঞ্জ, বনলতা, উপকূল, কালনী, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্তত ১১টি আন্তঃনগর ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। এছাড়া লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের ১৫টির শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিকাল ৪টার দিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও শিডিউল বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ২-৩ দিন সময় লাগবে।

এদিকে রোববার বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রেলভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২ শতাধিক শ্রমিকের মধ্যে ৩০ জন অংশ নেন। রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বৈঠক।

বৈঠকে থাকা রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান রাত পৌনে ৯টায় যুগান্তরকে জানান, শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় তাদের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার কথা আমরা শুনেছি। সারা দেশে তাদের সংখ্যা কয়েক হাজার। তাদের শান্ত রেখেই তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, বৈঠকে রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রেলওয়ে জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন রাত ৯টায় বলেন, বৈঠকে শ্রমিক প্রতিনিধিরা ৩টি দাবি জানিয়েছেন-১. তাদের চাকরি স্থায়ী করতে হবে। ২. আউডসোসিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। ৩. প্রতিনিধি দলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে হবে। এ তিন দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তারা বৈঠকে জানান।

তাদের দাবি অনুযায়ী ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রথমে রেলপথ মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে শ্রমিক প্রতিনিধি দল। তাদের বলা হয়েছে ২ সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যাবতীয় বিষয়ে কথা বলতে। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বিস্তারিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২ সপ্তাহের মধ্যে শ্রমিকরা কোনো আন্দোলন, অবরোধ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/696747/