১৭ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ৮:৩৮

ডেঙ্গুজ্বর প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

‘মশা মারতে কামান দাগা’ প্রবচনটি পড়েছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মশার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীকে মারার তার বংশবিস্তারের পথ রুদ্ধ করার তোড়জোড় দেখে সম্ভবত গুরুজনেরা এ আপ্ত বাক্যটির প্রচলন করেছিলেন। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজের জন্য ব্যাপক হই চই করে প্রস্তুতির জানান দেয়া অর্থে ব্যবহৃত হতো প্রবাদটি। তখন মশারির প্রচলন ছিল না বললেই চলে। ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বরের বাধাহীন রাজত্ব। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচির জন্য বিশাল তোড়জোড় আয়োজন। আজ ম্যালেরিয়া নেই বললেই চলে। অবশ্যই কামান দাগাতে হয়েছিল। ফগার মেশিন দিয়ে গ্রামগঞ্জ শহরে ওষুধ ছিটানো, মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করার অবিরাম কর্ম প্রচেষ্টা ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বরকে স্মৃতির মনিকোঠায় পাঠিয়েছে। কিন্তু স্বস্তি ফেরেনি। এখন প্রায় গোটা দেশ ডেঙ্গু আক্রান্ত। আক্রান্তের এবং মৃত্যুহার ২০১৯ সালের চাইতে তুলনামূলকভাবে বেশি। বর্ষা শুরুর আগেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, মশা শনাক্ত জরিপে এডিস মশার ঘনত্ব, বর্ষা প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা; সবমিলিয়ে এবার আক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়েছে আগস্ট সেপ্টেম্বরের আগেই। সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার দুটোই গত বছরের চেয়ে বেশি। ডেঙ্গুর মৌসুম তো পড়েই আছে। এর মধ্যেই অসুখটি ছড়িয়েছে সারা দেশে। এ পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির পরিমাণ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সামনে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টজন। ‘কামান দাগানোর’ চাইতে বড় কাজ ড্রোন উড়িয়ে ডেঙ্গুর উৎস খোঁজা ‘মশা মারতে কামান দাগা’ আপ্ত বাক্যটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। মশা নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর কাছে বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার আয়োজন উন্নতি আর সফলতা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকার মশক নিধন কর্মসূচিকে ব্যঙ্গ করে যেন প্রতি বছর আরো বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ছে মশা এবং ডেঙ্গু। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে ডেঙ্গু এখন ধরন বদলেছে; বদলেছে উপসর্গ। ফলে রোগী বা তার ঘনিষ্ঠজনেরা বুঝে উঠতে পারেন না ডেঙ্গু সংক্রমণ। যখন বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। জটিলতা বাড়তে থাকে, রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধ ছিটানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সাথে একে অপরকে দোষারোপের পুরনো সংস্কৃতিও ফিরে এসেছে। ২০২২ সালে ডেঙ্গু রোগে সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যায়। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২১ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।

মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১০৫ জন। ২০১৯ সালে সারা দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখেরও বেশি; যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। এ বছর ইতোমধ্যেই মৃতের সংখ্যা (১০ জুলাই’ ২৩) দাঁড়িয়েছে ৭৬ জনে, ডেঙ্গুর পুরো মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই। স্বভাবতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিটি করপোরেশন সর্বত্রই সাজ সাজ রব। সাথে সাথে বাড়ছে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর চাপ। বাড়ছে আশঙ্কা ও উদ্বেগ। এ মাসের ১১ তারিখে যেদিন আমি এ লেখা লিখছি, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ডেঙ্গু। আগের দিনের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী। জুলাই মাসের প্রথম দশ দিনে প্রাণহানি ঘটেছে ২৯ জনের। এ লেখা যখন আপনাদের হাতে পৌঁছবে, তখন এই চিত্র আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা। আমি, আপনি, আমাদের পরিবার, প্রতিবেশী কেউই ডেঙ্গুর মরণ থাবা থেকে নিরাপদ নই।

প্রতি বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু ডেঙ্গুর বিজয়রথ থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। পারস্পরিক সমালোচনা, দোষারোপ, অপরের গায়ে দায় চাপানোর একটা লুকোচুরি খেলা, এরপর সবকিছুই চুপচাপ নীরব। এর কারণটা খতিয়ে দেখা দরকার। ডেঙ্গু এখন জাতীয় সমস্যা। এর সমাধান করার জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে কর্মযোগ। যেভাবে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়ে নির্মূল করা হয়েছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, বসন্ত, কলেরা। মশা নির্মূল কার্যক্রম কেন বারবার ব্যর্থতার পর্যবসিত হচ্ছে তাও পুনর্মূল্যায়িত হওয়া দরকার। এর আলোকে প্রয়োজন সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ।

এক্ষেত্রে প্রথমত প্রয়োজন সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। বাড়ি ও আশপাশের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখা। যেখানে সম্ভব জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা। কোথায় কোনো ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং কি ধরনের ওষুধে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব এর আলোকে ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করা। যেখানে প্রয়োজন রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জন সচেতনতা; এটা বাড়াতে হবে। জনসচেতনতা না বাড়লে যেকোনো ধরনের কর্মসূচি ব্যর্থতার মুখে পড়বে। ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা। এর নিরসনে জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন বিস্তৃত এবং বাস্তবায়নযোগ্য কর্মযোগ। প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করার জন্য সপ্তাহে একটি বা দু’টি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। বয়স্কাউট, গার্লস গাইডসহ সমস্ত কিশোর ও শিশু প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত কার্যক্রমের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। একইভাবে পুলিশ, আনসার, বিজিবি সদস্যদেরও এ কার্যক্রমে সংযুক্ত করা যেতে পারে। বিভিন্ন সেনা ছাউনিগুলোকে আশপাশের জনবসতিগুলোতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজে উজ্জীবিত করা যেতে পারে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এক্ষেত্রে দেশজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে রাখতে পারেন অপরিসীম ভূমিকা। মোটকথা, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতাকে জন আন্দোলনে পরিণত করতে পারলেই সফলতা আশা করা যায়। নতুবা ডেঙ্গুর ভয়াল থাবার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া জনগণের আর কোনো উপায় থাকবে না। বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম চালু রাখা দরকার দেশজুড়ে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যার তত্ত্বাবধানে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বছরব্যাপী পরিচালিত হবে। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর এবং ফাইলেরিয়া যেভাবে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে; ডেঙ্গু জ্বরকেও এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/762697/