১৬ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ১২:২০

তথ্য সুরক্ষায় ব্যর্থতার দায় কার

সামনে নির্বাচন। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে তুলেছে। গত বুধবার ঢাকায় দল দুটির বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

নয়াপল্টনে সমাবেশ করে বিএনপি এবং বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ। ফলাফল বরাবরের মতোই। বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন, ‘দফা এক, দাবি এক-শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জনসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য ছিল, ‘আমাদেরও দফা একটা-শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়।’

দুই দলই তাদের অনড় অবস্থানের পক্ষে জনগণ সঙ্গে আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু সেই জনগণের অবস্থার কথা তারা কেউই জানেন না বা জানার চেষ্টা করেন না। সাধারণ মানুষ এখন আর কাউকে সমর্থন করার শক্তি রাখেন না। কারণ, ইতোমধ্যেই তারা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। চোখ তাদের ঝাপসা; তারা যেন দুদলকে চিনতে পারছেন না। জীবন তাদের দুর্বিষহ।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত সপ্তাহের একটি উদ্বেগজনক খবর। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা আমরা ফলাও করে দিনরাত প্রচার করছি, তার সুরক্ষার বিষয়ে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। প্রযুক্তি যেমন আমাদের পরম সুবিধা দিতে পারে, তেমনি এর সুরক্ষার অভাব আমাদের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ বিপদ সম্পর্কে অর্থাৎ নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আগাম কোনো সতর্কতার সক্রিয় প্রচেষ্টা নজরে পড়েনি।

যে কোনো নাগরিক জেনে বিস্মিত হবেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্রাক সাইবার সিকিউরিটি ইনফরমেশনের পরামর্শক ভিক্টর মার্কোপোলোস বাংলাদেশের এ তথ্য ফাঁসের কথা জানতে পারেন গত ২৭ জুন। তিনি তথ্য ফাঁসের ঘটনা জেনে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। মার্কোপোলোস বাংলাদেশ সরকারকে এ তথ্য জানিয়ে ছয় জায়গায় ই-মেইল করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর পাননি। তার মানে হলো, এরকম একটি বিপজ্জনক ঘটনার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বুঝতে অপারগ-অক্ষম।

প্রথমে তো কোনো বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবনে সক্ষম হতে হবে, তারপর প্রশ্ন আসবে তা প্রতিরোধ করার দক্ষতা নিয়ে। আমাদের এ দুটির কোনোটিই নেই। এরকম দায়িত্বহীনতা প্রত্যাশিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী শুক্রবার চাঞ্চল্যকর এ তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন অনলাইন পোর্টাল টেকক্রাঞ্চ। এ বিষয়ে গত ৯ জুলাই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ‘হ্যাক করে কেউ এই তথ্যগুলো নেয়নি, বরং ওয়েবসাইটের কারিগরি দুর্বলতা থেকে তথ্যগুলো ফাঁস হয়েছে। এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ২৯টি ওয়েবসাইট ঝুঁকিপূর্ণ, এটা আগেই বলা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার হামলায় ৮১ মিলিয়ন ডলার চলে যায়। তারপর থেকেই অনুধাবন করি সাইবার নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রতি মাসেই এ সংক্রান্ত মিটিং হয়। আমরা ২৯টি ওয়েবসাইটকে ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত করি। সেই তালিকায় থাকা ২৭ নম্বর প্রতিষ্ঠানটিই এ ধরনের অবস্থায় পড়ল।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, আগে থেকে জানার পরও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অক্ষম কিংবা উদাসীন।

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারে প্রায় ১২ কোটি নাগরিকের অন্তত ৪০ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক লেনদেন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ভূমিসেবা, সম্পদ, আঙুলের ছাপ, চোখের আইরিশসহ অনেক স্পর্শকাতর বিষয় অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া শিক্ষাগত ফলাফল, বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সনদসহ ব্যক্তির ছবি এবং স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৭১টি প্রতিষ্ঠান চুক্তির ধরন অনুযায়ী ওই ভান্ডার থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ব্যবহার করে। এর বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান সরাসরি নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করে। এদের ওপর নিয়মিত সাইবার নজরদারি করে বিজিডি ই-গভ সার্ট। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্র জানিয়েছে, কৃষি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি তারা খুঁজে পেয়েছেন।

আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তারা প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হলেও তথ্যপ্রযুক্তির ভালো-মন্দের বিষয়ে খুব একটা অবহিত নই। এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে কতটা বিপর্যয় দেখা দিতে পারে তা অনুধাবন করতে অসমর্থ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট পলিসি প্রণয়ন, সাইবার নিরাপত্তা, ইন্টারনেট গভর্নেন্সসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করেছেন সুমন আহমেদ সাবির। নিরাপত্তা নিয়ে তার বক্তব্যকে আমলে নেওয়া যেতে পারে। জনসাধারণ যে কোনো ডিজিটাল সেবা পেতে পরিচয়পত্র ব্যবহার করে থাকেন। এ ডেটা ফাঁস হওয়ায় এখন আমার আইডি কার্ড ব্যবহার করে যে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে। এর মাধ্যমে আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে ভার্চুয়ালি টাকা চুরি করতে পারে যে কোনো হ্যাকার। সাধারণ নাগরিকের এসব তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ায় কে কখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেউ জানে না। একজন নাগরিকের তথ্য ফাঁসের কারণে তার জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকেও কেউ অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। তার ব্যবসা-বাণিজ্যের নথিপত্র হাতিয়ে নিতে পারে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ পারিবারিকভাবে অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে, জায়গা-জমির কাগজপত্র হাতিয়ে নিতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা আরও ভয়ংকর পরিণতির আশঙ্কার কথা বললেন। তার মতে, ‘যেমন ধরুন আমি ডার্ক ওয়েব থেকে একটি অস্ত্র বা ড্রাগস কিনতে চাই। সেক্ষেত্রে আমার একটি বিটকয়েনের আইডি লাগবে। আমি আপনার পরিচয়পত্র ব্যবহার করলাম। আপনার আইডি কার্ড ব্যবহার করে আমি অস্ত্র কিনলাম অথচ আপনি কিছু জানেনই না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে আপনাকে ধরবে। ভয়াবহতার এখানেই শেষ নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপনার পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কেউ কোনো হোটেলে গিয়ে থাকল এবং সেখানে হত্যাকাণ্ডের মতো একটি জঘন্য কাজ করে সরে পড়ল। যেহেতু হোটেল রিজার্ভেশনে আপনার পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাই সব দায় গিয়ে পড়ল আপনার ওপর, যার কোনোকিছুই আপনি জানেন না। অথচ আপনাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। তথ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তা ব্যক্তিগত করুণ পরিণতির বাইরে রাষ্ট্রের জন্যও হুমকির কারণ হতে পারে। সুতরাং, তথ্য সুরক্ষায় আরও বেশি তৎপর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’
সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের তথ্য সুরক্ষা ঝুঁকিতে পড়েছে মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়কে অপচয় মনে করে। দ্বিতীয়ত, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের অধিকাংশই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত নন। তৃতীয়ত, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হলে তারা গুরুত্ব দেন না। এসব কারণেই ঝুঁকি তৈরি হয়। হ্যাকাররা তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটগুলোর দুর্বলতাকেই মূলত কাজে লাগান। অথচ উন্নত দেশগুলো তথ্য সুরক্ষায় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। গড়ে তুলছে ফায়ার ওয়াল।

সরকার এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে। ইতোমধ্যে তথ্য ফাঁস হওয়া সরকারি দপ্তর চিহ্নিত হয়েছে। ওয়েবসাইটের কোন ত্রুটিকে কাজে লাগিয়ে তথ্যগুলো বেহাত হয়েছে তা-ও জানা গেছে। তবে তথ্যগুলো কারা নিয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের একাধিক ইউনিট, আইসিটি বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তারা তথ্যগুলো বেহাত হওয়ার চ্যানেল খুঁজছেন। এটি কেবলই কারিগরি দুর্বলতা নাকি এর পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে সেটিও খতিয়ে দেখছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার থেকে তথ্য ব্যবহার করা সব প্রতিষ্ঠানের খুঁটিনাটি দেখা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো-আমরা কলস ভেঙে যাওয়ার পর সাবধান হই, ভাঙার আগে সতর্ক হতে মন চায় না।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা কতগুলো নেতিবাচক পরিণতির আশঙ্কার কথা বলেছেন, যা ঘটতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই সেই ভয়াবহ আশঙ্কার কতটা বাস্তবে ঘটবে। এ মুহূর্তে শুধু এটুকু বলা যায় যে, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক আজ উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। কেবল আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি এ মানসিক চাপকে নিরসন করতে পারবে না। চাই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। যারা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাদের নিত্যদিনের কর্মের মধ্যে অনেক অহেতুক তর্কের উপস্থিতি লক্ষ করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব নাগরিককে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখা সরকারের দায়িত্ব। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশ্ড প্রফেসর আলী রীয়াজের মন্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনা দেশে উপাত্ত সুরক্ষার দুবর্লতাকে তুলে ধরেছে। নিঃসন্দেহে এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তিগতভাবে পরিকাঠামোগুলো কতটা ভঙ্গুর তা দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেবল প্রযুক্তির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টার বিষয়ে সজাগ থাকা জরুরি। অন্যদিকে এ ঘটনাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে যেনতেনভাবে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ খসড়াকে যেন আইনে পরিণত করার চেষ্টা না হয়, সে ব্যাপারেও নাগরিকদের সতর্ক থাকতে হবে। নাগরিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে যারা কাজ করেন, তারা এ বিষয়ে সজাগ থাকবেন বলেই আশা করি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/696355/