১৬ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ১২:১৮

বাংলাদেশ এ্যাট দ্য ক্রস রোড : সংলাপের কোনোই সম্ভাবনা নাই : প্রসঙ্গত বাংলা ভাগের সঠিক তথ্য

আসিফ আরসালান

দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দল থেকেই সংলাপের সম্ভাবনা তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করা হয়েছে। সংলাপের কথা দিয়েই শুরু করি। বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত মার্কিন উচ্চ পর্যায়ের টিমও সংলাপের কথা বলেছেন। তাদের নেতা আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বলেছেন যে তারাও সংলাপ চান। তবে আমেরিকা কোনোরূপ সংলাপের সাথে যুক্ত হতে চায় না। তারা সংলাপকে ফ্যাসিলিটেট করবেন। অর্থাৎ সংলাপের পথ মসৃণ করবেন। কিন্তু নিজেরা এটি নিয়ে কোনো পক্ষকেই চাপ দেবেন না। অথবা নিজেরা সেই সংলাপে যুক্ত হবেন না।

উজরা জেয়ার এই কূটনৈতিক ভাষা থেকেই বোঝা যায় যে সংলাপের সম্ভাবনা এখন কত ক্ষীণ। সেজন্যই তিনি বিষয়টি বাংলাদেশের বিবদমান প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি এর আগেও সংগ্রামের এই কলামে একাধিকবার বলেছি যে দুই দলের মধ্যে সংলাপ যেন সেই, ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। অর্থাৎ দিল্লি বহুত দূর। হবে না কেন? সর্বশেষ যে অবস্থা তাতে সংলাপের কোনোই সম্ভাবনা নাই। কারণ সংলাপ করতে হলে কোথা থেকে শুরু করতে হবে?

আওয়ামী লীগ বলছে, বর্তমান সংবিধানের অধীনে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। অন্যদিকে একই দিনে অপর একটি মঞ্চ থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন যে যদি কোনো সংলাপ করতেই হয় তাহলে সর্বপ্রথম শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়।

আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে দুই তিনটি নামজাদা পত্রিকার এবং কয়েকজন নামজাদা সুধী পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করছেন ঠিকই, কিন্তু কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছেন না। তারাও বলছেন যে দেশ যে ভয়ঙ্কর সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। সেখান থেকে উত্তরণের জন্য সংলাপের কোনো বিকল্প নাই। তাদের এসব কথা শুনে এবং পত্র পত্রিকায় দেখে আমার অতীত দিনের স্মৃতি মনে পড়লো। মনে পড়লো, এক সময়কার প্রবল আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ এবং ইসলামী পন্ডিৎ মরহুম আবুল হাশিমের কথা। আবুল হাশিম আমাকে কি বলেছিলেন সেটি বলার আগে তার সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ বর্তমান প্রজন্ম তার সম্পর্কে তো কিছু জানেই না। এমনকি তার নামটিও অনেকে জানেন না। তাই অতি সংক্ষেপে তার একটি পরিচিতি দেওয়া প্রয়োজন।

জনাব আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বেঙ্গল মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি। তখনও ভারত তথা বাংলা ভাগ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশ মিলে ছিল বেঙ্গল বা বাংলা। আবুল হাশিম এবং শেখ মুজিবুর রহমান (বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) একসঙ্গে মিলে মুসলিম লীগের প্ল্যাটফর্ম থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে দেখা যায়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তার কি কঠোর সংগ্রাম। ঐ গ্রন্থের একাধিক স্থানে রয়েছে শেখ মুজিবের চিন্তাধারা। একাধিক স্থানে তিনি বলেছেন, ভারতবর্ষের মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

সোহরাওয়ার্দীও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক ডামাডোলের বাইরে যদি সময় হয় তাহলে আমি অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে একাধিক উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাবো যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিবের কি বিপুল অবদান ছিল।
১৯৪৪ সালের আগ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমির নাম পাকিস্তান হবে, তেমন চিন্তা করেননি। পাকিস্তান শব্দটি এসেছে এরপর। তখন দেখা গেল যে ভারত বিভক্তি মানে পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগ হবে। এমন অবস্থায় মুসলিম লীগের দুই নেতা এবং কংগ্রেসের দুই নেতা চিন্তা করলেন যে পাঞ্জাব ভাগ হবে কিনা সেটা পাঞ্জাবীদের বিষয়। কিন্তু তারা চাইলেন যে বাংলা ভাগ না করেই অখন্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে।

॥ দুই ॥
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তখন পাঞ্জাবও অখন্ড ছিল। ভারত ভাগের ফলে পাঞ্জাবের বৃহত্তর অংশ পাকিস্তানের ভাগে চলে যায়। এটির নাম হয় পশ্চিম পাঞ্জাব। ভারতীয়দের ভাগে পড়ে পূর্ব পাঞ্জাব। ভারত বিভক্তির পর অর্থাৎ ভারত স্বাধীন হওয়ার ১৯৬৬ সালে প্রশাসনিক কারণে স্বাধীন ভারতে পাঞ্জাব তিন ভাগে বিভক্ত হয়। একটি শিখ সম্প্রদায় অধ্যুষিত পাঞ্জাব। এবং অপর দুটি রাজ্য হলো হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশ। অখন্ড বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগ সেক্রেটারি আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের দুই নেতা নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর ভাই শরৎচন্দ্র বসু এবং কিরণ শংকর রায় স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করেন এবং যুক্ত বাংলার কথা বলেন। জবাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান যে যুক্ত বাংলা যদি স্বাধীন থাকতে পারে তাহলে তার আপত্তি নাই। কিন্তু সেটি যদি ভারতে যায় তাহলে তার আপত্তি আছে। সেক্ষেত্রে যুক্ত বাংলাই হোক, আর খন্ডিত বাংলাই হোক, সেটিকে পাকিস্তানে থাকতে হবে।

সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম খুশি হয়ে প্রসন্ন মনে ফিরে আসেন। এই খবর শুনে শরৎ বসু এবং কিরণ শংকর কংগ্রেসের ক্লিয়ারেন্সের জন্য দিল্লি যান। দিল্লিতে তারা কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহরু এবং সরদার প্যাটেলের সাথে দেখা করেন। নেহরু এবং প্যাটেল যুক্ত বাংলার কথা শুনে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হন এবং অনেকটা অপমান করে শরৎ বসু এবং কিরণ শংকরকে ফিরিয়ে দেন। এর ফল যা হবার তাই হলো। বাংলার লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলিতে (বাংলার আইনসভা) হিন্দু সদস্যরা উদয় চাঁদ মেহতার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা বিভক্তির পক্ষে রায় দেন। পক্ষান্তরে মুসলিম সদস্যরা নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে বাংলা অখন্ড রাখার পক্ষে রায় দেন। তখন ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের পার্টিশন প্ল্যান মোতাবেক বাংলাকে বিভক্ত না করে উপায় ছিল না। সেদিন বিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের নাম হয় পূর্ব বাংলা। আর পশ্চিমাঞ্চলের নাম হয় পশ্চিম বঙ্গ। সেই পূর্ব বাংলাই আজ স্বাধীন বাংলাদেশ।

॥ তিন ॥

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হলেও আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দী কয়েক বছর কলকাতাতেই থেকে যান। কয়েক বছর পর তারা উভয়েই পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। পূর্ব বাংলায় সোহরাওয়ার্দী প্রথমে মুসলিম লীগের সাথে থাকার পর জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করেন। এরপর তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যুক্ত হন। আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে আওয়ামী লীগ হয়। ঐদিকে জনাব আবুল হাশিম পূর্ব পাকিস্তানে এসে কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকেন। অতঃপর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগদানের পর গ্রেফতার হন। এরপর তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টি গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচনে রব্বানী পার্টি থেকে অধ্যাপক আবুল কাশেম এবং অধ্যাপক শাহেদ আলী পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর আবুল হাশিম এই ফাউন্ডেশনের প্রথম ডিরেক্টর নিযুক্ত হন।

॥ চার ॥
এই ছিলেন মরহুম আবুল হাশিম। বর্তমানে ৯৩ বছর বয়স্ক বামপন্থী নেতা ড. বদরুদ্দিন ওমর আবুল হাশিমের পুত্র। যখন আবুল হাশিম ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রধান ছিলেন তখন তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। তিনি একটি কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম, The Creed of Islam. গ্রন্থটির বাংলা নাম, ইসলামের মর্মবাণী। আবুল হাশিম ছিলেন বি এ পাশ। অথচ তার ক্রিড অব ইসলাম গ্রন্থটি কানাডার ম্যাকগ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। মনীষী আবুল হাশিম একদিন এক বৈকালিক আড্ডায় বলেছিলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো Where to begin অর্থাৎ কোথা থেকে শুরু করবো। To begin with, we should start from the fundamentals of Islam.

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটভূমিকায় বিশেষ করে যারা সংলাপের কথা বলেন তাদের কাছে প্রশ্ন করবো, Where to begin নবমরহ অর্থাৎ কোথা থেকে শুরু করবো। শুক্রবার দুই একটি নাম করা পত্রিকায় অন্তত তিন জন নাম করা সাবেক আমলা বলেছেন যে পর্দার অন্তরালে হোক বা বাইরে হোক, সমঝোতা হতেই হবে। কিসের সমঝোতা? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ ১৯৯৪-৯৬ বলেছিলেন যে কেয়ারটেকার সরকার দিতেই হবে। এই দাবিতে তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন এবং বিপুল সংখ্যক গাড়ি ঘোড়ায় অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর করেছিলেন। এই করে তারা বিএনপি সরকারকে কেয়ারটেকার সরকার দিতে বাধ্য করেছিলেন। সেদিন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল সমঝোতার যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন সেটি ছিল অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কিন্তু সেটিও আওয়ামী লীগ মানেনি। সেদিন তো এসব সুধী এবং পত্র পত্রিকা যে কোনো মূল্যে সমঝোতার কথা বলেননি। কারণ বললে তো নমনীয় হতে হতো আওয়ামী লীগকে।

আজ তাহলে সমঝোতা কোন পয়েন্টে হবে? সোজা কথা, ইংরেজি ভাষায় বলতে হলে Bangladesh is now at a cross road. অর্থাৎ সংঘাতের মুখে বাংলাদেশ। এটি হলো এখন ‘হয় এসপার নাহয় ওসপার’ অবস্থা। এই সংঘাতে কোনো এক জোট জিতবে, অপর জোটটি হারবে। কে হারবে, কে জিতবে? এখন সেটি বলা সম্ভব হচ্ছে না।

এ্যান্থনি ব্লিংকেনের ভিসা নীতিতে শুধুমাত্র ফ্রি এবং ফেয়ার ইলেকশনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ইনক্লুসিভ এবং Participatory শব্দ দুটি ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া Inclusive শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ১৪ জুলাই ইংরেজি দৈনিক নিউ এজে Participatory শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ বলতে বিষয়টি পরিষ্কার হয় না। এটি কি ইনক্লুসিভ ইলেকশন? এটি কি Participatory ইলেকশন? কিছুই পরিষ্কার নয়। আগামীতে আরো কিছু ঘটবে। পাঠক, আপনারা ফিঙ্গার ক্রস করে রাখুন।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.info/post/529997