১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ৮:৫৫

উত্তরাঞ্চলে বন্যার ব্যাপক অবনতি

উত্তরাঞ্চলের তিন জেলায় বন্যার ব্যাপক অবনতি। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী। স্কুল কলেজ বন্ধ। বিশুদ্ধপানি ও শুকনো খাবারের অভাব। স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মুখে। ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া আশঙ্কা। সরকারি ত্রাণ এবং চিকিৎসা সেবা জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছানো দাবি জানান বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সংবাদদাতারা জানান-
লালমনিরহাট সংবাদদাতা : গতকাল শুক্রবার সকাল ৬ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর ডালিয়া ব্যারেজে বিপৎসীমার ৪০ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে নদীর বাম তীরের প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। পানি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় আরো নতুন নতুন এলাকা বন্যায় তলিয়ে গেছে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দী এসব পরিবারের সদস্যরা। গবাদি পশু-পাখি আর মৎস্য খামারিরাও চরম বিপাকে পড়েছেন।

ব্যারেজ ও নদী তীরবর্তী মানুষ জানান, গত কয়েক দিনের থেমে -থেমে ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারেজের লালমনিরহাট অংশের সব কটি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাত থেকে পানি বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টায় থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা সকাল ৯ টা পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। দুপুর ১২ টায় কিছুটা কমে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ২৮ মিটার।

যা বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপরে। কিছু সময়ের ব্যবধানে সন্ধা ৬ টার পর বিপদ সীমার ৩৬ সে.মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে এভাবে সময়ের ব্যবধানে শুক্রবার বিকেল ৩ টা থেকে বিপদসীমার ৪০ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার তীরবর্তী ও লালমনিরহাটের ৫ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে এবং নতুন নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫ টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সব কয়টি উপজেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পানি যত বাড়ছে নদী পাড়ের মানুষের আতঙ্ক ততই বাড়ছে। চরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

পানিবন্দী পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নদীপাড়ের অধিকাংশ পরিবারের সুপেয় পানির টিউবওয়েল পানির নিচে ডুবে গেছে। পায়খানা ডুবে যাওয়ায় পুরুষরা বাহিরে যেতে পারলেও নারীরা প্রস্রাব পায়খানায় ব্যাপারে চরম বিপাকে পড়েছেন। মাচাং বানিয়ে তাতে রান্না করছেন নারীরা। এক বেলা রান্না করে চালিয়ে নিচ্ছেন ২/৩ বেলা। মাচাংয়ের ওপর পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিস্তা পাড়ের পানিবন্দী পরিবারগুলো। বন্যার কারণে এসব এলাকায় সাপসহ পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এসব পরিবার।

হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মজিবুল আলম সাহাদাত জানান, তাদের ইউনিয়নের অসংখ্য পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ক্রমে বাড়ছে পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে অবগত করা হয়েছে বলেও জানান তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা জানান, বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়েছে। সব জলকপাট খুলে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টা এবং সকাল ৯ টায় বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। দুপুর ১২টায় মাত্র ৬ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সন্ধা ৬ টায় বিপদসীমার ৩৫ সেঃ মিঃ ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। টানা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিপদসীমার ৪০ সেঃ মিঃ ওপরে থাকায় তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যা বলেন, তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে সকালে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জরুরি প্রয়োজনসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে। আমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মাধ্যমে সকল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।

ফুঁসে উঠেছে তিস্তা ॥ ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী
উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে ফুঁসে উঠেছে তিস্তা। তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৬ টার পর থেকে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে নদী ঘেঁষা ১৫টি চরগ্রামে পানি উঠেছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তিস্তার পানি বাড়তে থাকে এবং সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে ফুঁসে উঠে তিস্তা। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬ টা থেকে তিস্তার পানি ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় । সকাল ৯টায় ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে। তবে দুপুরের পর থেকে পানি কমতে শুরু করে। বিকেল ৩টায় পানি কমে ৭সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় এই পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় । পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১৫টি চরের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের বসত বাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওইসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা। ওই সব গ্রামের মানুষজন পানি আরো বাড়ার আতংকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছেন।

পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতীফ খান জানান তার ইউনিয়নের দু’টি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবারের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। খালিশা চাপানি বাইশপুকুর গ্রামের আব্দুস সামাদ জানান তাদের গ্রামের কমবেশি প্রতিটি বাড়িতে পানি উঠেছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে রয়েছে এই গ্রামের লোকজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আসফাউদ দৌলা জানান, উজানের ঢলে তিস্তার পানি গত দু’দিন ধরে হু হু করে বাড়ছে। শুক্রবার সকালে এ মৌসুমের সর্বোচ্চ বিপৎসীমা ৪০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে তিস্তার পানি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সতর্ক রয়েছে বলে তিনি জানান।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন কতজন মানুষ পানিবন্দী হয়েছে তা এখন সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন গুলোর চেয়ারম্যানদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে।
গাইবান্ধায় বেড়েছে সব নদীর পানি ॥ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

গাইবান্ধায় তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়াসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বেড়েছে। লোকালয় ও নিম্নাঞ্চলসহ নতুন নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। এতে বন্যা আতঙ্কে আছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। গতকাল শুক্রবার দুপুরে গাইবান্ধা সদর উপজেলার নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, ফুলছড়ি পয়েন্টে যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ও চক রহিমাপুর পয়েন্টে করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৪০৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের নবাবগঞ্জ গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, গত দুদিন থেকে তিস্তার নদীর পানি ব্যাপকহারে বেড়েছে। মরিচ ও পাটের জমি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে একই উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের কাজিয়ার চরের বাসিন্দা জামিউল ম-ল বলেন, কাল রাত থেকে অনেক পানি বেড়েছে। গত কয়েকদিনে অনেক আবাদি জমি নদীতে ভেঙে গেছে। তিস্তা নদীর ভাঙন এখনো অব্যাহত আছে। সদর উপজেলার গোমাট গ্রামের আরিফুল ইসলাম বলেন, বাড়ির চারদিকে পানি। ঠিকমতো বের হওয়া যাচ্ছে না। সবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানি যে হারে বাড়ছে তাতে সবজিক্ষেত পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। বন্যা হলে তো বাড়িতেও থাকা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়বে। গাইবান্ধা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক বলেন, উজানের ঢল আর বৃষ্টির পানিতে জেলার সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে।

https://dailysangram.info/post/529976