১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ৮:৫১

বেসরকারি হাসপাতালে বিপুল ব্যয়

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আবু বক্কর সিদ্দিক। ঢাকার মানিকনগরের এই বাসিন্দা পেশায় ফেরিওয়ালা। সঙ্গে থাকা তাঁর স্ত্রী নাদিয়া আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভর্তির দিনই পাঁচটি পরীক্ষা করিয়েছি। এর মধ্যে এই হাসপাতালে দুইটা, বাইরে তিনটা।

এতে আমার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরপর স্যালাইন, ক্যানোলা, ওষুধপত্র, দুজনের খাওয়া-দাওয়াসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই খরচ জোগাতে ১০ হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে।’
বেসরকারি হাসপাতালে খরচ আরো বেশি।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের ৫ ও ৬ জুলাই রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আতাউর রহমান। এতে তাঁর খরচ হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি। আতাউর রহমানের ভাই মো. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শয্যা ভাড়া নিয়েছে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা করে, এ ছাড়া একাধিক পরীক্ষা, ওষুধসহ বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে এক লাখ বিল করেছে।
অনেক পরীক্ষা করা হয়েছে অকারণে।
আমাদের জন্য এটা অনেক বেশি খরচ।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীদের ওষুধপত্র, বিভিন্ন পরীক্ষা, খাওয়াদাওয়াসহ খরচ হচ্ছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। একই চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালে খরচ পড়ছে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। বেসরকারি বড় হাসপাতালে গেলে খরচ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে তিন থেকে চার লাখ টাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সব পরীক্ষার সুযোগ মেলে না।

বাধ্য হয়ে কিছু পরীক্ষা বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে করতে হচ্ছে। এতে ধারণার চেয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত কারণে হয়, তাই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেমন—জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। রোগী খেতে না পারলে শিরাপথে স্যালাইন বা গ্লুকোজ দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্লাটিলেট কাউন্ট জানতে সিবিসি পরীক্ষা করতে হয়। রোগীভেদে ব্লাড সুগার টেস্ট, লিভারের প্রদাহ পরীক্ষা, পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, বুকের এক্স-রে, রক্ত ও প্রস্রাবের কালচার পরীক্ষা করতে হতে পারে। এসবের পেছনে বেশ টাকা লাগে।

বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে : ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সরকারি ২০টি হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি আছে এক হাজার ৫০০ জন। বেসরকারি ৩৩টি হাসপাতালে ভর্তি এক হাজার ২৫৫ জন। গত মাসের এই সময়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৪৫০ জন। বেসরকারিতে ভর্তি ছিল ২১৭ জন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে সরকারিতে রোগী বেড়েছে তিন গুণের বেশি। আর বেসরকারিতে বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।

ধানমণ্ডির ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগীর স্বজন মনিরা সুলতানার সঙ্গে। তিনি জানান, ভর্তির প্রথম দিনে তাঁর খরচ হয়েছে ৪২ হাজার টাকা।

মনিরা সুলতানা বলেন, এখানে প্রতিরাতের স্ট্যান্ডার্ড সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১০ হাজার টাকা, ডাবল বেডের কেবিনে প্রতি বেডের জন্য ভাড়া চার-পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ আর খাওয়ার খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তাঁদের প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

ল্যাবএইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদার কাছে ডেঙ্গু রোগীদের এই বিপুল ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা হতেই পারে না। রোগীর অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, সেটা আগে জানা জরুরি। যদি অন্য কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে এমন খরচ হতে পারে। আমরা কোনো রোগী থেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছি না।’

হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর অতিরিক্ত খরচের অন্যতম আরেকটি কারণ অ্যাপারেসিস প্লাটিলেট। ডেঙ্গু রোগী একই সঙ্গে অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছে বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন—এমন রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট প্রয়োজন। রক্তের প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে এক থেকে তিন ব্যাগ পর্যন্ত প্লাটিলেট দিতে হচ্ছে রোগীকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা এক ব্যাগ প্লাটিলেট বাবদ খরচ পড়ে ১৪ হাজার টাকা। বেসরকারিতে গেলে এ জন্য টাকা গুনতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে এত বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। আমরা সিবিসি করছি ১২০ টাকায়, ডেঙ্গু টেস্ট ৫০ টাকায়, এ ছাড়া রোগীর জটিলতা বুঝে অন্যান্য পরীক্ষা দিলেও সেটি বাইরে থেকে যদি রোগীরা করেন, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের এখানে সব পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘৫০০ বেডের হাসপাতালে এক হাজার ১৮৫ জন রোগী ভর্তি আছে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের লক্ষ্মীপুর, ফেনী, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী আসছে আমাদের হাসপাতালে।’

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ ২০৭ জন ডেঙ্গু রোগীর আট দিনের খরচের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালভেদে আট দিনে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে।

হাসপাতালে নতুন রোগী ৪৪৯ জন : দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৪৯ জন। এই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট চার হাজার ২২০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এ বছর মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৮৩১ জন। ডেঙ্গুতে মারা গেছে মোট ৯৩ জন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/15/1298750