১৩ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

কম বয়সীরা বেশি ঝুঁকিতে

ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দেওয়ায় শিশু নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন অভিভাবকরা। ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
শিশু রাফার কয়েক দিন ধরে জ্বর। মা-বাবা ভেবেছিলেন সাধারণ জ্বর। এক পর্যায়ে খিঁচুনি শুরু হলে তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষার পর ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও তাকে ভর্তি করা যায়নি।
কারণ একটি শয্যাও খালি নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে রাফার মা শিরিন আক্তারের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা যায়। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এসেছেন তাঁরা।

শুধু রাফা নয়, তার মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে আসা আরো অনেক শিশুরই এমন দুরবস্থা দেখা যায়।
এসব শিশুকে অভিভাবকরা হাসপাতালে নিয়ে আসছেন, কিন্তু কোনো শয্যা খালি না থাকায় ভর্তি করানো যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতি চারজনে একজন শিশু। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক থেকে ১০ বছরের শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এক বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আরো পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে। একই সময়ে আরো এক হাজার ২৩৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ৯৩ জন মারা গেছে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট চার হাজার ৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।
তাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে এক হাজার ৩৬১ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ১৭ হাজার ৩৮২ জন।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে ঢাকার শিশু হাসপাতালের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায়, সামনের চত্বরে মশারি টানিয়ে ঘুমাচ্ছে অন্তত অর্ধশত মানুষ। অনেকে মশারির ভেতর মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সন্তান বা স্বজন হাসপাতালে ভর্তি। তাদের অনেকে রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে এসেছে। কেউ কেউ এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে।
সকাল ১১টার দিকে হাসপালটির বহির্বিভাগের ১৩৫ ও জরুরি বিভাগের ১৩৬ নম্বর কক্ষের সামনে অসুস্থ শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা এমন ভিড় জমান, পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত ছিল না।

দুপুর ১২টার দিকে সাত মাস বয়সী আদিত্যকে কোলে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য টিকিট কাটছিলেন তার বাবা উজ্জ্বল সাহা। কথা বলে জানা গেল, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে এসেছেন। সকাল থেকে আদিত্যর পাতলা পায়খানা হচ্ছে, গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। ঠিক তার পাশেই চার মাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আরেক মা। তিনি এসেছেন নরসিংদী থেকে।
পাশে থাকা আরেক শিশুর বাবা সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, চার দিন ধরে জ্বর জ্বর ভাব ছিল বাচ্চার। গত রাতে (পরশু) হঠাৎ জ্বর বেড়ে যায়। একই সঙ্গে তার পেট ব্যথা। তাই বাচ্চাকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। এখন অন্য হাসপাতালে যাবেন।

টিকিট কাউন্টারে কথা বলে জানা যায়, এর মধ্যে ২০০ টিকিট দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই রাজধানীর বাইরের। জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া, ডেঙ্গুসহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদেরও নিয়ে আসা হয় এখানে।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা ছিলেন প্রচণ্ড ব্যস্ত। এক চিকিৎসক জানান, সকাল থেকে মাত্র চারজনকে ভর্তি করা হয়েছে। বেড খালি নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই চিকিৎসক বলেন, এখানে চিকিৎসার জন্য অনেক মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে আসেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তাঁরা এমন সময়ে এসেছেন যখন বাচ্চাকে ভর্তি করা প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় অনেক রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হয় না।

‘একটি বেডও খালি থাকে না’ : শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের শিশু হাসপাতালে ৬৮১টি শয্যা রয়েছে। রাত ৯টার পর একটিও খালি থাকে না। তখন আর কোনো রোগী ভর্তি করতে পারি না। বাড়তি রোগীরা ফেরত যায়। আমাদের এখানে এনআইসিইউ, আইসিইউ, আরআইসিইউ রয়েছে ১০০টি। এগুলো সব সময় ভরা থাকে।’
ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে ৬০ জন। আইসিইউতে রয়েছে চারজন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ২০৮ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে দুজন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের আমরা আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছি। হাসাপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ারগুলোতে দায়িত্বরত প্রত্যেক ইনচার্জকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা বিছানা রাখতে বলে দিয়েছি, যাতে গুরুতর কোনো রোগী ফেরত না যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকেই আলাদা সেল গঠন করেছি। ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড ডাক্তার, নার্স দেওয়া হয়েছে, যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ডেঙ্গু নিয়ে।

অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথার ওষুধে মৃত্যুঝুঁকি : হাসপাতালটির সহাকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে যারা অন্য রোগে আক্রান্ত, তাদের হাসপাতালে বেশি ভর্তি থাকতে হচ্ছে। এক থেকে ১০ বছরের শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এক বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।

তিনি বলেন, বেশির ভাগ রোগী আসছে জ্বর বা ডায়রিয়া হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর। এতে রোগী গুরুতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দেখা যায় কারো ফুসফুসে পানি চলে আসছে, পেটে পানি চলে আসছে কিংবা রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেকের আসার পরপরই আইসিইউ সাপোর্ট লাগছে। এসব রোগী ১০ থেকে ১৫ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছে।

ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, শিশুর জ্বর এলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ডাক্তার নিশ্চিত করবেন শিশুর ডেঙ্গু হয়েছে কি না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথার ওষুধ সেবন করা যাবে না। এতে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/14/1298462