১৩ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩২

সন্দ্বীপে আড়াই কোটি টাকার প্রকল্প

বুঝিয়ে দেওয়ার পরই ধসে গেছে গাইড ওয়াল ও সড়ক

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে আড়াই কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয় ফেরিঘাট সংযোগ সড়ক এবং সড়ক রক্ষায় গাইড ওয়াল। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগে মাত্র ২ মাস! কিন্তু এ প্রকল্পের কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কয়েকদিন পরই গাইড ওয়ালসহ সড়কের একাংশ ধসে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও অপরিকল্পিতভাবে গাইড ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া তড়িঘড়ি ও যেনতেনভাবে প্রকল্প বুঝিয়ে দিয়ে বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কয়েকদিন না যেতেই সড়ক ও গাইড ওয়াল ধসে পড়েছে। এজন্য তারা প্রকল্প কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের দায়ী করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

সূত্র জানিয়েছে, মীরসরাই অর্থনৈতিক জোন থেকে সন্দ্বীপে যোগাযোগের জন্য ফেরি সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এজন্য সন্দ্বীপের গাছুয়া ইউনিয়নের সাগর তীরে ঘাট (পন্টুন বা প্ল্যাটফরম) নির্মাণের ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের আগাম প্রস্তুতি হিসাবেই সাগর থেকে বেড়িবাঁধের দিকে ২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এজন্য আড়াই কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়।

সূত্র জানায়, এখানে আমির মোহাম্মদ ঘাট নামে একটি দীর্ঘদিনের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী নৌ-ঘাট ছিল। এ ঘাটে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল। সড়ক সংস্কার না হওয়া, ঘাটে নামার সুব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণে সড়ক ও ঘাটটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। যে কারণে ফেরিঘাট নির্মাণের আগে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) আওতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে গঠন করা হয় একটি কমিটি। কমিটির সভাপতি করা হয় গাছুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনাকে। সদস্য সচিব করা হয় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আদনান জাবেদকে।

সূত্র জানায়, মে-র শুরুর দিকে কাজ শুরু করে প্রকল্প কমিটি। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় সন্দ্বীপবাসী আশান্বিত হয়ে ওঠেন। যাতায়াতের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করেন তারা। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর কাজের ধরন দেখে দ্বীপবাসী হতাশায় নিমজ্জিত হন। একটা খরস্রোতা সাগর উপকূলে চ্যানেল ঘেঁষে তৈরি করা সড়ক রক্ষায় বোরিং বা গ্রেডবিম ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছিল ওয়াল।

এমনকি নামেমাত্র লোহার রড ব্যবহার করা হয়। এ কারণে এটি ভেঙে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয় তাদের মধ্যে।
কুরবানি ঈদের ৩ দিন আগে প্রকল্প কমিটি পিআইও অফিসকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। জুন ফাইনালের আগেই নিয়ে নেয় বিল। কিন্তু কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কয়েকদিন না যেতেই কুরবানির ঈদের পরপর উত্তাল সাগরের ঢেউয়ে নির্মিত গাইডওয়ালটি ভেঙে পড়ে। সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ধসে পড়ে আংশিক সড়ক।

অভিযোগ উঠেছে, সন্দ্বীপের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার আস্থাভাজন আওয়ামী লীগ-যুবলীগের দুই নেতা-আবু হেনা ও জাবেদকে করা হয়েছিল প্রকল্প কমিটির সভাপতি-সচিব। আড়াই কোটি টাকার বিশাল একটি প্রকল্পের কাজ মাত্র ২ মাসেই শেষ করে দেন তারা। খরস্রোতা সাগরে আরসিসি ওয়াল না দিয়ে, ব্র্যান্ডবিহীন নিম্নমানের ইট দিয়ে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয় গাইডওয়াল। ৮-১০টি এক্সকেভেটর লাগিয়ে মাটি কেটে রাতারাতি সড়ক নির্মাণেও রয়েছে নানা ত্রুটি।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী যুবলীগের সহসভাপতি ও সন্দ্বীপের অপর একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু সেই বরাদ্দের বিশাল অংশ নানা কৌশলে লোপাট হচ্ছে। গাছুয়া ইউনিয়নের ফেরিঘাটের সড়ক ও গাইড ওয়াল নির্মাণ প্রকল্পের বেহাল দশার জন্যও লুটপাট ও সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতাই দায়ী বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, আড়াই কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২ মাসে শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে তাই হয়েছে।

প্রকল্প কমিটির সভাপতি ও গাছুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেনা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ২ মাসের মধ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছি। বর্ষা চলে আসবে তাই ১০-১২টি এক্সকেভেটর লাগিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। গত ঈদের ৩ দিন আগে প্রকল্পটি পিআইও (প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) অফিসকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আমাদের আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। নিম্নমানের কাজ হওয়া ও প্রকল্প থেকে টাকা লোপাটের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত পুরো কাজটা তদারকি করেছেন প্রকল্প কমিটির সেক্রটারি জাবেদ।’

তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে সাগরের তীরে আরসিসি ওয়াল ছাড়া এ ধরনের সাধারণ গাইড ওয়াল নির্মাণ করলে তা ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, কাবিখার অর্থে মূলত মাটির কাজ করা হয়। আড়াই কোটি টাকার সেই প্রকল্পের টাকা থেকেই গাইড ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। রাজনৈতি প্রতিপক্ষ এ নিয়ে তিলকে তাল করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সন্দ্বীপ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোহাম্মদ ইসমাঈল যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলকভাবে গাইড ওয়ালটি নির্মাণ করেছিলাম সড়ক রক্ষার জন্য। কারণ কাবিখার টাকায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে বোরিং করা বা আরসিসি ওয়াল দেওয়ার সুযোগ নেই। উত্তাল সাগরের ধাক্কায় গাইড ওয়াল ও সড়কের ২০-৩০ ফিট অংশ ধসে পড়েছে। ২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২০-৩০ ফুট সড়কের মাটি বা বালি সরে যাওয়া বেশি কিছু নয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/695305