১৩ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৯

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল : একটি বিলম্বিত বিশ্লেষণ

-ড. মো. নূরুল আমিন

॥ গতকালের পর ॥
কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে ঈমানদার মুসলমানদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তিকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে গণ্য করার কোন উপায় নেই। এখন বাংলাদেশের সংবিধানে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের যে প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশন তুলেছেন তা কি আসলে কার্যকর আছে? বাংলাদেশে বিচার বিভাগের ক্ষমতা বেশি না পার্লামেন্টের, এ নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংসদ যখন সংবিধান সংশোধন করে তখন সংসদ বা পার্লামেন্ট তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে। এই সরকারের আমলেই এই বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে এবং এই নিয়ে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির মন্তব্য এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উত্তেজনাকর আলোচনা ও স্পিকারের রুলিং উচ্চ আদালত কর্তৃক বে আইনি ঘোষণা করার পরও সংসদকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলার সুযোগ সম্ভবত আর থাকে না। এই অবস্থায় শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশের একটি রাজনৈতিক দল তার গঠনতন্ত্রে আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ও রাজাধিরাজ ঘোষণা করার মধ্যে কোন ত্রুটি থাকতে পারে না। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর কথা আমি আগেই বলেছি। নাস্তিক কমিউনিস্টদের সমালোচনা এবং ইসলাম বিরোধিতা এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের জন্য জামায়াত বিরোধী প্রেরণার উৎস হওয়া বাঞ্ছিত নয়। এক্ষেত্রে জাতীয় সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে বিষয়টি স্মরণ করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করব। এখানে সংবিধানের ১১৯নং অনুচ্ছেদে কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘(১) রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনানুযায়ী-ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; খ) সংসদে সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; গ) সংসদের প্রতিটি আসনে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন এবং ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।

এখানে সংবিধানের কোথাও কোন রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয় নাই এবং দুনিয়ার কোথাও কোনও দেশেই নির্বাচন কমিশনের কথামত কোন রাজনৈতিক দল উঠবস করে না। নির্বাচন কমিশন জনগণের নির্বাচিত কোন সংস্থাও নয়। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত জনকল্যাণের জন্য নিবেদিত জনগণেরই একটি প্রতিষ্ঠান।

এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। এক একটি রাজনৈতিক দলের একেক রকম উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি থাকতে পারে। জামায়াতে ইসলামীরও আছে। জামায়াত তার গঠনতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জাতীয় সংবিধানে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের গঠনতন্ত্রে মার্কস, এঞ্জেলস-এর আদর্শ অনুযায়ী সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এদেশের ৯০ ভাগ লোক মুসলমান এবং তারা নাস্তিক নয়। তারা কমিউনিস্টদের ন্যায় আল্লাহকে ‘মানুষের চরম দুশমন’ বলেও মনে করে না। কিন্তু তথাপিও গণমানুষের ধর্মে বিশ্বাস, আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা বিরোধী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত উপরোক্ত দলগুলোর গঠনতন্ত্রকে নির্বাচন কমিশন আপত্তিকর মনে করেনি। বরং এ ধরনের গঠনতন্ত্র পেশ করার জন্য কমিশনের তরফ থেকে তাদেরকে ধন্যবাদ দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে তার গঠনতন্ত্রের জন্যে হয়রানি করা হচ্ছে এবং ইসলাম বিদ্বেষী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট ও মন্তব্যকে ভিত্তি করে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এর কারণ বোধগম্য নয়।

আবার যদি ধরে নেয়া হয় যে, জামায়াতের গঠনতন্ত্রে এমন কিছু আছে যা জাতীয় সংবিধানের সাথে মিলে না। সে ক্ষেত্রেও তা আপত্তির বিষয় হতে পারে না। কেননা জামায়াতের সংবিধানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজ কাঠামো এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন চায়। এই চাওয়াটা স্বাভাবিক এবং এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তারা যদি দেশের মানুষকে তাদের আদর্শের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং মানুষ তা মেনে নেয় তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা সংবিধান সংশোধন করেই তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করবে, বন্দুকের নলের মুখে অথবা অগণতান্ত্রিক কোনও পন্থায় নয়। ইসলামের অনুশাসনভিত্তিক একটি দল হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্র চাওয়া এবং সে জন্য রাজনীতি করা অবৈধ নয়। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.) এটা করেছেন। তিনি যা করেছেন মুসলমানদের জন্য তা সুন্নাহ এবং এটা স্বাভাবিক। এর আরেকটি দিকও আছে। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সংবিধানের ৪১ নং অনুচ্ছেদ কতিপয় অধিকারও প্রদান করেছে এবং যেটা হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার তারা ভোগ করেন। একটি রাজনৈতিক দল যদি ইসলামকে তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার অনুশাসন অনুশীলন ও প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে রাষ্ট্র বা নির্বাচন কমিশন তাকে বাধা দিতে পারে না। এই অবস্থায় জামায়াতের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের আপত্তিসমূহের বিচার বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি এবং আমি এটাও মনে করি যে, জাগতিক জগতে জনগণের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে এবং করছে তা ধর্মীয় স্বাধীনতারই অংশ। এদের বাধা দিয়ে সরকার সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি করছেন এবং নির্বাচন কমিশনকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে অনেকে মনে করছেন। এখন আদালতকেও সামনে এনেছেন। এর আশু সুরাহা না হলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। এক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোর কোনটিরই বৈধতা আর থাকবে না এবং এর ফলে যে সংকট সৃষ্টি হবে তা হবে ভয়াবহ। (সমাপ্ত)

https://dailysangram.info/post/529773