২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৭

রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ

এমনিতেই গ্রীষ্মকাল। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে, তার উপরে বিদ্যুতের লোডশেডিং। এতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। পল্লী বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। দেশের কোথাও কোথাও ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগ আসছে অহরহ। কোথাও আসা- যাওয়ার মধ্যে আছে বিদ্যুৎ। চলমান গ্রীষ্মকাল ও আসন্ন রমজানে গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও গ্যাস সংকটে ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা নিয়েই সংকট দেখা দিয়েছে। সমপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক সভায় রমজান এবং গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের সরবরাহে সটেজের কারণে এক হাজারের উপরে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আছে সঞ্চালন লাইনের সমস্যাও। এই পরিস্থিতি সামলাতে ভারত থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রেডিয়াল মোডে আমদানির বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। রেডিয়াল মোড হচ্ছে- আমাদের দেশের কোনো একটি ছোট অংশের সঙ্গে ভারতের কোনো একটি অংশে বিদ্যুতের লাইন সংযোগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্যকে (বিতরণ) আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট এ সংক্রান্ত একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কি প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি করা যায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে দাখিল করতে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি আদেশ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড হাতে পেয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এখনই গড়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন সমিতিগুলোর বিতরণ এলাকায় ৮০০ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিতরণ উপকেন্দ্রগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বিভিন্ন এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। কোনো কোনো এলাকায় দু-একদিন পর বিদ্যুতের দেখা মিলে। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। সূত্র জানায়, চলতি বছর রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। তবে গ্যাস স্বল্পতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ও রমজান মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশের সব সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার কথাও বলা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের দিবাপিক, সন্ধ্যাকালীন পিক এবং সেহরির সময় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল পর্যায়ক্রমে ৭৯০০, ৯০৩৬ ও ৮৮৪১ মেগাওয়াট। এ বছর চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৯৩০, ১০ হাজার ২০০ ও ১০ হাজার মেগাওয়াট। এ বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। গত বছর রমজানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দৈনিক গড় সরবরাহ ছিল এক হাজার ৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সর্বোচ্চ সরবরাহ ছিল এক হাজার ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এ বছর গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়লেও গ্যাসের সরবরাহ এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ আছে ৯৪০ থেকে ৯৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে। চলতি বছর বিদ্যুতের উৎপাদন চাহিদা পূরণ করতে হলে ১১৫০ থেকে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চাহিদা অনুযায়ী পেট্রোবাংলার গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখন পেট্রোবাংলাকে গ্যাস সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, চাইলেই গ্যাস সরবরাহ করা যায় না। প্রতিনিয়ত গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। ফলে বিদ্যুৎ পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা কঠিন। পাওয়ার সেলের এক কর্মকর্তা বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের বিষয়ে বলেন, কিছু কিছু সমস্যা আছে। সঞ্চালন ও বিতরণের সমস্যা আছে। গ্যাস থেকে প্রায় ৬ হাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু সেখান থেকে পুরোটা পাওয়া যায় না। ফলে প্রকৃত উৎপাদন কমে যায়।
সমপ্রতি বৈঠক এবং বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামলাতে ভারত থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রেডিয়াল মোডে আমদানির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি)-এর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি আদেশও জারি হয়েছে। সারা দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের কারণে উৎপাদনে একটু ঘাটতি আছে। সঞ্চালন লাইনের কারণেও সমস্যা হয়।
সূত্র জানায়, বিদ্যুতের মূল জ্বালানি হলো গ্যাস। ৬৭ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস দিয়ে। গ্যাসের অভাবে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এই গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই। বহু সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের অভাবে অচল বসে আছে। তেল দিয়ে উৎপাদন হয় ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ। বাকিটা কয়লা ও জলবিদ্যুৎ। অতিমাত্রায় গরম ও অতিরিক্ত লাইনের কারণে পল্লী এলাকায় লোডশেডিং হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। গরম বাড়ার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে এসি, ফ্রিজ, ফ্যানসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক মেশিনের ব্যবহার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, সরকারের হিসাবের স্বচ্ছতার অভাব আছে। সরকার তার অভ্যন্তরীণ হিসাব ধরে। এক্সট্রানাল হিসাব ধরে না। প্রতি বছরেই এরকম ঘটনা ঘটে। এখন বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। কোনো সমন্বয় নেই। উৎপাদন বাড়িয়েছে। কিন্তু জ্বালানির সরবরাহ বাড়েনি। সরকার বিদ্যুতের যে লোডশেডিংয়ের হিসাব দিয়েছে, তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে চাহিদা আরো বেশি। তিনি বলেন, কারিগরি বিষয়ে অনুমাননির্ভর কথা বলা উচিত নয়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63179&cat=3/