১২ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১০:৫০

আষাঢ়েও মিলছে না ইলিশ, দাম বেড়েছে দ্বিগুণ

জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই ইলিশের মৌসুম শুরু। কিন্তু এবার ভরা আষাঢ়েও নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে না। বঙ্গোপসাগরে চলছে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ইলিশ ধরতে না পারায় দুর্দিনে পড়েছেন জেলেরা।

অন্যদিকে সরবরাহ কমায় দেশের বাজারে ইলিশ মাছের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। রাজধানীর বাজারে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করছেন বিক্রেতারা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর এই সময়ে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছিল এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়।
বাংলাদেশে সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চললেও ভারতে তা নেই।

সেখানকার জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ফলে কলকাতার বাজারগুলো রুপালি ইলিশে ভরে গেছে। দামও আগের চেয়ে কমেছে।

কলকাতার এক বাংলা সংবাদমাধ্যমে গত সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৫০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।

কেজি পড়ছে এক হাজার ২০০ টাকা। এক কেজি থেকে এক কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৮০০ টাকায়। দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়।
গত সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায়, ৮০০ গ্রামের ইলিশ কেজিপ্রতি এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ইলিশ আরো বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

কারওয়ান বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী ফরহাদ হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাগরে এখন ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলছে। তাই বাজারে ইলিশের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এ কারণে বাজারে ইলিশের দাম বাড়তি। গত বছর এই সময়ে যে দামে ইলিশ বিক্রি করেছিলাম, এখন তার চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

চাঁদপুর : চাঁদপুরে পাইকারি ইলিশের বাজার বড় স্টেশন। বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে এই মাছবাজারে কয়েক শ মণ ইলিশ সরবরাহ ছিল। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরগরম থাকত বাজারটি। এবার সেই চিত্র নেই। ইলিশের সরবরাহ একেবারেই কম। দামও বেশ চড়া। ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২৭ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা। আর এক কেজি থেকে এক কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ এক লাখ টাকা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় বড় স্টেশন মাছবাজারে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার কারণে সামুদ্রিক ইলিশের সরবরাহ একেবারেই বন্ধ। তার মধ্যে মেঘনার মোহনা থেকে শুরু করে উজানের দিকে যেসব জেলে নদীতে মাছ শিকার করছেন, তাঁরা নানা ধরনের হয়রানিতে আছেন। ফলে জেলেরা ঝুঁকি নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে সাহস করছেন না।’

চাঁদপুর সদরের হরিণাঘাট এলাকার জেলে বিল্লাল মিশৌরী বলেন, ‘নদীতে কয়েক ঘণ্টা জাল ফেলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলছে না।’ একই কথা বলেন পাশের আখনেরহাট এলাকার জেলে আলমগীর হোসেনও।

দেশের বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, ‘পরিভ্রমণশীল স্বভাবের মাছ ইলিশ। ঝাঁক বেঁধে সাগরে ও সাগর মোহনা ছেড়ে নদীর দিকে ছুটে চলে। তবে বৃষ্টিপাত ও স্রোত এ ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই জেলেদের এখনো হতাশ হওয়ার কারণ নেই। শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত ইলিশের দেখা মিলবে। সুতরাং একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
তবে এই মৎস্যবিজ্ঞানী আরেকটি শঙ্কার কথাও বলেছেন, পানিতে দূষণ, ডুবোচর ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইলিশের চলাচলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

বরিশাল : বরিশাল শহরের মাছবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের হাতে গোনা ইলিশ সবে বাজারে আসতে শুরু করছে। তা-ও অনিয়মিত। দাম কেজিপ্রতি দেড় হাজারের আশপাশে।
আরিফুর রহমান নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘৬৮০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ এক হাজার ৫৫০ টাকা দরে কিনেছি। বাজারে ইলিশের আমদানি খুবই সামান্য।’

এদিকে আষাঢ়ের শেষে এসেও নদ-নদীতে ইলিশের হদিস না পেয়ে জেলেরা হতাশ। বঙ্গোপসাগর তীরের পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজের জেলে সুলতান সরদার মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগুনমুখা, বুড়াগৌরাঙ্গ ও রামনাবাদ নদীতে ইলিশের দেখা নেই। নদীগুলোতে ইলিশের কোনো খবর নেই। জেলেরা নদী থেকে শূন্যহাতে ফিরছেন। কারণ নদীতে প্রচণ্ড গরম। বৃষ্টি তেমন একটা নেই। এমন আবহাওয়ায় ইলিশের দেখা মেলা ভার।’ ২৩ জুলাই সাগরে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে হয়তো ইলিশের দেখা মিলতে পারে বলে ধারণা এই জেলের।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক লোকমান আলী বলেন, ‘হিসাবে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এবার জাটকা নিধন মৌসুমে মাছ ধরা হয়নি। নদীতে নৌকা চলেনি বলে ইলিশের প্রজনন পর্ব এবার নির্বিঘ্ন হয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রজননের সঙ্গে সঙ্গে ইলিশ বড় হয়ে নদী ভরে যাবে, এই ভাবনা ঠিক নয়। এমনিতেই ইলিশের বৃদ্ধি খুব ধীরগতিতে হয়। এবার ইলিশের ভালো প্রজননের ফল মিলতে পারে মৌসুমের শেষ ভাগে।’

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : রামনাবাদ নদের জেলে মো. ইকবাল বলেন, ‘নদীতে এখন ইলিশের দেখা পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। কেননা ইলিশ তার জীবনচক্রের কারণে গভীর সমুদ্রে চলে গেছে। নদীতে ইলিশ নেই বললেই চলে।’
কলাপাড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী মো. মাহবুব হোসেন জানান, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা, ৮০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি এক হাজার ২০০ টাকা দরে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/12/1297834