১২ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১০:৪৮

ঢাকার বাইরে অর্ধেক রোগী ১০ জেলায়

চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৭০৬ জন। এর আগের ১০ দিনে ভর্তি হয়েছিল ৬৭৪ জন। অর্থাৎ ১০ দিনের ব্যবধানে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে চার গুণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে এক হাজার ৫৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ সময়ে মারা গেছে সাতজন। এ বছর এ পর্যন্ত এক দিনে রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে ৬১ জেলায়।
এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি ৫০ শতাংশ রোগী রয়েছে ১০ জেলায়। এসব জেলার মধ্যে বর্তমানে চট্টগ্রামে ভর্তি ১২৮, ফরিদপুরে ৬৩, পটুয়াখালীতে ৫৩, পিরোজপুরে ৪৮, গাজীপুরে ৪২, মাদারীপুরে ৩৪, চাঁদপুরে ৩৪, ভোলায় ২৮, লক্ষ্মীপুরে ২২ এবং শরীয়তপুরে ২৩ জন। তিন জেলায় এখনো কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। এসব জেলা হচ্ছে গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ।
এ বছর এ পর্যন্ত যে ১০ জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে, এর মধ্যে চট্টগ্রামে ভর্তি ৭৪৯ জন, পটুয়াখালীতে ২২২ জন, চাঁদপুরে ২০৮ জন, বরিশালে ১৭৭ জন, কক্সবাজারে ১৫৮ জন, পিরোজপুরে ১৩৫ জন, ফরিদপুরে ১৩১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১২৯ জন, মাদারীপুরে ১২৫ জন ও বরগুনায় ১২২ জন।

এক দিনে ৭ জনের মৃত্যু, ভর্তি ১০৫৪ : দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক দিনে আরো সাতজন মারা গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরো এক হাজার ৫৪ জন। এ নিয়ে জুলাইয়ের প্রথম ১১ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। হাসপাতালে ভর্তি ছয় হাজার ৯১৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৬২৮ জন ঢাকার ও ৪২৬ জন ঢাকার বাইরের। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন ঢাকার ও একজন ময়মনসিংহের। নতুন ভর্তি রোগীদের নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি তিন হাজার ৩০৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় দুই হাজার ৩০৬ জন ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৯৭ জন।

ঢাকামুখী হচ্ছে রোগীরা : ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অনেকে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছে। এদের একজন নরসিংদীর বেলাবর রহিম মিয়া। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রহিম মিয়া বলেন, ছয় দিন ধরে জ্বর। ডাক্তার ওষুধ দিলেও জ্বর কমে না। পরে পরীক্ষা করে জানতে পারি ডেঙ্গু। গতকাল থেকে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, এখানে এসেছি ভালো চিকিৎসার জন্য। কয়েক দিন ধরে কিছুটা সুস্থ বোধ করছি।

এই হাসপাতালে লক্ষ্মীপুর সদর থেকে এসেছেন সিরাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘টানা জ্বর। কত ওষুধ খেয়েছি, সারে না। পরে ডাক্তার টেস্ট দেন। টেস্ট করে দেখি ডেঙ্গু হয়েছে। অপেক্ষা না করে ঢাকায় চলে আসছি। এখন আল্লাহ ভরসা।’

রহিম আর সিরাজের মতো এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বরিশালের রিপন ও রাজবাড়ীর জিসান। তাঁদের ভাষ্য, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকার হাসপাতালে আসার উদ্দেশ্য দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা। এখানে মৃত্যুঝুঁকিটা কম।

ঢাকা মেডিক্যালের সক্ষমতা রয়েছে ২০০ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার। কিন্তু রোগীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। বেশির ভাগ রোগীকে হাসপাতালের বারান্দা ও সিঁড়িতে চিকিৎসাসেবা নিতে দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. নাজমুল হক বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে রোগী আসছে। আমরা কোনো রোগীকে ফেরত দিচ্ছি না। যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

রোগী ঢাকায় আনা ঝুঁকিপূর্ণ : সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা কম। অনেক চিকিৎসক-নার্স আছেন, যাঁদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা কম। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জাম ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এ কারণে ঢাকার প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। ঢাকার বাইরে যদি চিকিৎসার সক্ষমতা না বাড়ানো যায়, এতে রোগীরা আরো বেশি ঢাকামুখী হবে। এতে রোগীর জীবনের ঝুঁকি যেমন বাড়বে, তেমনি ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়বে।

চট্টগ্রাম জেলায় রোগী বেড়েছে ১৬ গুণ : ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছরের জুলাইয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল মাত্র ৬৫ জন। এ বছর গতকাল পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৪০ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম ১০ দিনে পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় রোগী বেড়েছে ১৬ গুণ। এমন পরিস্থিতিতে আমরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। পরীক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। তবে এখনো বিনা মূল্যে পরীক্ষা করাতে পারছে না রোগীরা।’

গত বছর ছিল ১ জন, এ বছরে ৯২ জন : গাজীপুরে গত ১০ দিনে ৯২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল মাত্র একজন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯২ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে সামনে রোগী বাড়বে—এ বিষয়টি মাথায় রেখেই হাসপাতালগুলোতে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে আলাদা ইউনিট, বিনা মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা—সবই করা হয়েছে। এ ছাড়া মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি আমরাও সচেতনভাবে কাজ করছি।’

কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালের প্রস্তুতি নিয়ে সমস্যা নেই। এখন পর্যন্ত যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের অনেকে ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছিল। স্থানীয় রোগীও কিছু রয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ১০৮ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে ৯১ জন। বর্তমানে ভর্তি আছে ১৭ জন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/12/1297825