১২ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১০:৩৪

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল : একটি বিলম্বিত বিশ্লেষণ

ড. মো. নূরুল আমিন

॥ গতকালের পর ॥
৭ নং ধারায় জামায়াতের সদস্য বা রুকন হওয়ার শর্তাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। এই শর্তাবলির মধ্যে আটটি উপধারা সংযোজিত আছে এবং এর প্রথম চারটি উপধারা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন তার আপত্তি জানিয়ে বলেছে যে, এই উপধারাগুলো পালন করা বাস্তবসম্মত নয়। এই ধারা ও সংশ্লিষ্ট উপধারাগুলো নিম্নরূপ:

‘বাংলাদেশের যে কোন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী এই জামায়াতের সদস্য (রুকন) হইতে পারিবেন যদি তিনি-
১। ইসলামের মৌলিক আক্বীদা, উহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ বুঝিয়া লওয়ার পর এই সাক্ষ্য দেন যে, ইহাই তাহার জীবনের আক্বীদা:
২। জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উহার ব্যাখ্যাসহকারে বুঝিয়া লওয়ার পর স্বীকার করেন যে, ইহাই তাহার জীবনের উদ্দেশ্য ও

লক্ষ্য:
৩। এই গঠনতন্ত্র পাঠ করিবার পর এই ওয়াদা করেন যে, তিনি ইহার অনুসরণে জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানিয়া চলিবেন:
৪। শরীয়াতের নির্ধারিত ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করিবেন এবং কবীরা গুনাহ হইতে বিরত থাকিবেন।
একইভাবে ১১ নং ধারার দুই উপধারা সম্পর্কেও কমিশন থেকে আপত্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এই উপধারায় বাংলাদেশের যে কোন অমুসলিম নাগরিকের জামায়াতের সদস্য হবার শর্তাবলি বর্ণিত আছে এবং এতে বলা হয়েছে যে, যারা এই শর্তগুলো পালন করবেন তারা জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন। শর্তগুলো হচ্ছে:-

ক) জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা বা সিদ্ধান্তসমূহ নিষ্ঠার সহিত মানিয়া চলিবেন।
খ) জামায়াতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিবেন।
গ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করিবেন।
ঘ) উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন করিবেন না।’ এই শর্তগুলো কিভাবে অবাস্তব তা দেশবাসীর কাছে বোধগম্য নয়।

এছাড়াও গঠনতন্ত্রের ১৮ নং ধারার ৪ নং উপধারায় ‘চ’ অনুচ্ছেদের ব্যাপারেও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। এই ধারাটি হচ্ছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সংক্রান্ত এবং আপত্তিকৃত ‘চ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে,
‘আমীরে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সহিত পরামর্শ করিয়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যকে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন যাহাদের মোট সংখ্যা কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার নির্বাচিত সদস্যগণের ১৫%-এর অধিক হইবে না।’
এখন নির্বাচন কমিশনের এই আপত্তিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

আমার প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং এই দলিলটি অপরিবর্তনশীল দলিল নয়।

এ যাবত এই দলিলটির ১৬ বার সংশোধন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যে হবে না সে সম্পর্কে গ্যারান্টি দিয়ে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। সংবিধান মানুষের তৈরি একটি দলিল এবং মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। তবে এ কথা সত্য যে বিদ্যমান দলিলের আলোকে আমাদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ এবং ব্যক্তি ও সংস্থাসমূহের তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের বর্তমানে যে সংবিধান বলবৎ রয়েছে সেই সংবিধানটির মূল প্রস্তাবনাই শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ অর্থাৎ দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। এর অর্থ যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে- রাষ্ট্র আল্লাহর অনুগতই থাকবে এবং আল্লাহর নাম নিয়েই এই সংবিধানটি শুরু করা হয়েছে। এই সংবিধানের ২ (ক) ধারায় এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে।

এই ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। এই সংবিধানের ৪১ ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। এবং খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত বিধানগুলো সামনে রেখে যদি নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের তথাকথিত আপত্তিকৃত ধারা-উপধারাগুলো বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে আমাদের জাতীয় সংবিধানের সাথে এর সংঘাত-সংঘর্ষের কোন বিষয়ই নজরে পড়ে না।

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম যদি ইসলাম হয় তাহলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই আল্লাহর অনুগত থাকতে হয়। এই অবস্থায় জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও আইন সভার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার সমতুল্য প্রতীয়মান হবার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। নির্বাচন কমিশনের এ ব্যাখ্যা বাস্তবসম্মত হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত ধারাগুলো পার্লামেন্ট বা আইনসভা সংক্রান্ত এই ধারাগুলোর কোথাও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করা হয়নি। ৬৫ নং অনুচ্ছেদের (১) উপ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জাতীয় সংসদ নামে বাংলাদেশে একটি সংসদ থাকবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত থাকিবে:

তবে শর্ত থাকে যে, সংসদের আইন দ্বারা যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন বা আইনগত কার্যকারিতাসম্পন্ন অন্যান্য চুক্তিপত্র প্রণয়নের ক্ষমতার্পণ হইতে এই দফার কোন কিছুই সংসদকে নিবৃত্ত করিবে না।’
নির্বাচন কমিশনের পত্রে সংসদের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে অস্বীকারের যে কথাটি বলা হয়েছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২(৫) ধারাটির ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হতে পারে না। জামায়াত গঠনতন্ত্রের ২(৫) ধারাটি আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
এতে জামায়াতের মৌলিক আক্বীদা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, জামায়াত ও তার সদস্যরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশা, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না।

কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না... ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে সার্বভৌমত্বের বিষয়টি এসেছে। পবিত্র কুরআনে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, রাজাধিরাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূরা নাসে আল্লাহকে বলা হয়েছে ‘রাব্বিন নাস’ তথা মানুষের রব। যার অর্থ হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির প্রতিপালক, মালিক ও প্রভু। এই সূরায় তাকে ‘মালিকীন নাস’ও বলা হয়েছে।

এর অর্থ মানুষের বাদশাহ, সমগ্র মানব জাতির শাসক ও পরিচালক। তিনি ‘ইলাহিন নাস’ও। অর্থাৎ তিনি মানুষের ইলাহ বা মাবুদ, ইবাদত পাবার একমাত্র মালিক। একইভাবে সূরা আলে-ইমরানের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে হে নবী! বলুন, রাজত্বের মালিক হে আল্লাহ, তুমি যাকে চাও তাকে রাজত্ব দান কর। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা হয় রাজত্ব কেড়ে নাও এবং যাকে চাও, সম্মান দান কর। যাকে চাও অপমানিত কর। সকল প্রকার মঙ্গল ও কল্যাণ তোমার এখতিয়ারে, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান। (কুলিল্লাহ হুম্মা মালেকুল মুলকে তু’তিল মুলকা মান তাসাউ ওয়াতানজিউল মুলকা মিম্মানতাসাউ ওয়া তুইজ্জো মানতাসাউ, ওয়া তুজ্জেল্লো মান তাসাউ বি ইয়াদিকাল খায়ের। ইন্নাকা আলা কুল্লে সাইয়িন ক্বাদির)। (চলবে)

https://dailysangram.info/post/529648