১২ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১০:২৯

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল : একটি বিলম্বিত বিশ্লেষণ

ড. মো. নূরুল আমিন

ঢাকাসহ দেশব্যাপী রাজনৈতিক ময়দানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক সক্রিয় ও সরব পদচারণা সকল মহলের আলোচনার মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। এতে জামায়াতকে যারা আদর্শিকভাবে পছন্দ করেন না তাদের মধ্যে যেমনি একটি আতঙ্কের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তেমনি জামায়াত ঘরানার অনেকের মধ্যেও অতিউৎসাহের ভাব দেখা যায়। কোন কোন মহলের মতে জামায়াত আসন্ন নির্বাচনে ৩০০টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে; আবার কারুর কারুর মতে ১৬০টি আসনে তারা মনোনয়ন দিচ্ছেন। বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করছেন যে, সরকার ও তার বন্ধু ভাবাপন্ন দেশ ও এজেন্সিগুলো যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি না হয় তাহলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে পারে। জামায়াতের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে তার নিবন্ধনের বিষয়টিরও এখনো কোন নিষ্পত্তি হয়নি। বলাবাহুল্য, ২০১৩ সালে আদালত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জামায়াতকে প্রদত্ত নিবন্ধন তার এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনী ঘোষণা করেছিল। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আপীল আবেদন দাখিল করেছিল। কিন্তু এগার বছরেও এই আপীলের শুনানি বা নিষ্পত্তি হয়নি। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে জামায়াত কিভাবে নিজ প্রতীক ও বৈধতা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিবে?

কেন কি কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে তার প্রকৃত কারণ বা অবস্থা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা জামায়াতের অনেক নেতাকর্মীও জানেন না। এ প্রেক্ষিতে নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি আলোচনা করা জরুরি বলে আমার মনে হয়।

আগেই বলেছি রাজনৈতিক দল হিসাবে হাইকোর্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ২০১৩ সালের পয়লা আগস্ট বিচারপতি এম. মোয়াজ্জম হোসেন, বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এই রায় দেন। একজন বিচারপতি এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। রায়ে আদালত বলেছেন নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে যে নিবন্ধন দিয়েছে তা অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। রায়ের পর নির্বাচন কমিশনের কৌঁসুলি মহসীন রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আদালত রুল মঞ্জুর করেছেন। নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার কারণগুলো পরে জানা যাবে। তিনি বলেন, এই রায়ের সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। ফলে ইসি’র নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে দলীয় প্রতীক নিয়ে জামায়াত আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। জামায়াত অবশ্য সংবিধানের ১০৩ ধারা অনুযায়ী আপীল করার বিষয়ে আদালত থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপীল আবেদন পেশ করেছে। এই রায় প্রকাশের পর পরই আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যে, এই রায়টি জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন যে, শুরু থেকে ক্ষমতাসীন সরকার জামায়াতের ওপর যে নির্যাতন চালিয়ে আসছেন দলটির নিবন্ধন বাতিলের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। সরকারের ধারণা জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পুনরায় ক্ষমতায় আসা তাদের জন্য সহজতর হবে। আওয়ামী ঘরানার দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে জামায়াত বিরোধী তৎপরতা পরিচালনার অগ্রগামী ভূমিকাও পালন করছে। কয়েক বছর আগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে আইনী প্রক্রিয়ায়ই তারা অগ্রসর হবেন এবং ২০০৯ সালে মাইজভা-ার ভিত্তিক তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টিসহ আওয়ামী ঘেঁষা ২৫টি সংগঠন জামায়াতের নিবন্ধনের বিরুদ্ধে যে রীট মামলা করেছে সে মামলাটি জিন্দা করা হবে। তার কথা মত মামলাটি জিন্দা হয়েছে এবং তার রায় জামায়াতের বিরুদ্ধে গেছে। এখানে আইনমন্ত্রীর জয় হয়েছে বলে মনে হয়। আদালতের স্বাধীনতা ও ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন যে, একটি রাজনৈতিক ইস্যু রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা না করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে সরকার নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।

অবশ্য জামায়াতের ওপর সরকারের রুদ্ররোষ আজকে প্রথম নয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে জামায়াতের রাজনীতিকেও নিষিদ্ধ করেছিল। এর আগে পাকিস্তান আমলে তৎকালীন জামায়াত দু’বার নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রথমবার হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। জেনারেল আইয়ূব খান সামরিক শাসন জারির পর অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের সাথে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হামলায় অধিবেশন পরিচালনারত ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী নিহত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তখন সামরিক শাসন জারী হয়েছিল। দ্বিতীয়বার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আইয়ুবের দুঃশাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের সক্রিয় ভূমিকার কারণে ১৯৬৪ সালে। এই সময় সরকার ১৯০৮ সালের ফৌজদারী আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেছিল। সুপ্রীম কোর্ট এই আদেশকে খারিজ করে দেন এবং অভিমত প্রকাশ করেন যে, ফৌজদারী আইনের ১৬ নং ধারাটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং নাগরিকদের Freedom of Association এর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী (17 DLR (SC) 209)।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, পাকিস্তান আমলে Freedom of Association এর যে মৌলিক অধিকার আদালত সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ আমলে এসে আমাদের উচ্চ আদালত এই মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করলেন। কেন করলেন তা বুঝা মুশকিল। তবে একটা কথা বলে রাখি যে, রায় প্রকাশিত হবার পর ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট বলেছিল যে এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন তখন তাদের অনলাইন জরীপের একটি ফল প্রকাশ করেছে। এতে ১৪ দলের এই মন্তব্যের ওপর পাঠকদের মতামত চাওয়া হয়েছিল। ফলাফল অনুযায়ী পাঠকদের শতকরা ১৫.৩০ ভাগ ১৪ দলের সাথে একমত প্রকাশ করেছে। আবার ৮৩.৭২ শতাংশ বলেছেন যে তারা জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করেন না। ০.৯৮ শতাংশ কোন মতামত দেননি। জরীপের ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। এখন আমি জামায়াতের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। এই গঠনতন্ত্রের কতিপয় ধারাকে নির্বাচন কমিশন ও সরকার বাংলাদেশ সংবিধানের পরিপন্থী আখ্যায়িত করেছে। এই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সাথে জামায়াতের পত্র যোগাযোগ চলছিল। কয়েক দফা জামায়াত কমিশনের চাহিদানুযায়ী তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধনও করেছে। এই পর্যায়ে আদালতের রায়কে অনেকে অনভিপ্রেত বলে মনে করেছেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গত ৪ নবেম্বর (২০১২) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে একটি পত্র দিয়েছিল। এই পত্রে সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের বেশ কয়েকটি ধারা এবং উপধারা সংশোধনকরতঃ ৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনে দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের যে সমস্ত ধারা, উপধারায় বর্ণিত বিষয়সমূহকে নির্বাচন কমিশন আপত্তিকর বলে উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে (১) আল্লাহ্্ ছাড়া অপর কাউকে বাদশাহ্্, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে মেনে না নেয়া, (২) ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালানো, (৩) দায়িত্বশীল নাগরিক ও চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠন (৪) সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা, (৫) ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা (৬) সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম ও সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানো এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা এবং উপার্জনে অবৈধ পন্থা রোধ করা প্রভৃতি। নির্বাচন কমিশনের পত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ওপর আপত্তি উত্থাপনের ধরন দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কেননা এই বিষয়গুলো ইসলামী অনুশাসনেরই অংশ। কেউ কেউ বলছেন যে, আমরা নিশ্চয়ই ফেরাউন-নমরুদের দেশে বাস করছি না। যেখানে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হারাম ছিল। সরকার জামায়াত নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য তখন সংগঠনটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হয় হুলিয়া জারি করে রেখেছিলেন না হয় কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাদের কেন্দ্রীয়, মহানগরী এবং জেলাপর্যায়ের বহু অফিস খুলতে দেয়া হয়নি। পুলিশ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই অবস্থায় জামায়াতের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পত্রটির একটি জবাবও দেয়া হয়েছে। তার আগে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা জরুরি বলে আমি মনে করি।

নির্বাচন কমিশন তার সর্বশেষ পত্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ধারা ২ এর ৫ উপধারা, ধারা ৩, ধারা ৫-এর উপধারা ৩, ধারা ৬-এর উপধারা ৪, ধারা ৭-এর উপধারা ১ থেকে ৪, ধারা ১১-এর উপধারা ২, ধারা ১৮-এর উপধারা ৪(চ) এবং গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠায় বিধৃত বিশেষ নোটের দফা (৩) বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধনকরতঃ সংশোধিত গঠনতন্ত্রের মুদ্রিত তিন কপি (প্রতি পৃষ্ঠা সত্যায়িত করে) ঐ বছরের ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দলটিকে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে বলেছিল, জামায়াত তা করেছে।

বলাবাহুল্য, এর আগে ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন এক পত্রযোগে জামায়াতকে জানিয়েছিল যে, ক) দলটির গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারার আংশিক বিধান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও আইনসভার কর্তৃত্বকে অস্বীকারের সমতুল্য প্রতীয়মান হতে পারে। (খ) গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বর্ণিত ইসলামী সমাজ গঠন ও ধারা ৩ এ বর্ণিত ইসলামী জীবনবিধান কায়েমের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় (গ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৫ উপধারা ৩ এ বর্ণিত ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম এবং ধারা ৬ ও উপধারা ৪ এ বর্ণিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার বিধান বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। (ঘ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৭ উপধারা ১-৪ এ বর্ণিত বিধান এবং ধারা ১১ উপধারা ২ এ বর্ণিত অমুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হওয়ার বিষয়টি বা অমুসলিম সদস্যের দলে সদস্যভুক্তির জন্য প্রস্তুতকৃত শপথনামা বাস্তবসম্মত নয়। গঠনতন্ত্রের এই দুটি বিধান দলের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী। (ঙ) গঠনতন্ত্রের ধারা ১৮ উপধারা ৪ (চ) এ বর্ণিত আমীরের মনোনয়ন প্রদানের ক্ষমতা ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৯০ ই(ও) (ন) (র) বিধানের পরিপন্থী। (চ) গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠায় বিশেষ নোটের দফা ৩ এ বর্ণিত বিষয়টি একটি ধারা আকারে দলের গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশ করা প্রয়েজন। জামায়াত কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে। তবে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপোষ করেনি। কেননা আপোষ করলে মুসলমানদের ঈমান থাকে না। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে মূল আলোচনা ও বিশ্লেষণের আগে আমি জামায়াতের গঠনতন্ত্রের যে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংবিধানের দোহাই দিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে দলটির গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে সে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর প্রকৃত অবস্থা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ২ নং ধারার ৫ নং ধারাটি আপত্তিকর বলে অভিহিত করেছে। এই ধারাটি হচ্ছে জামায়াতের মৌলিক আক্বিদা সংক্রান্ত। এতে জামায়াত “ইসলামের মৌলিক আক্বিদা...লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-এই কালেমাকে জামায়াতের আকিদা হিসাবে গ্রহণ করেছে যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত কোনও ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। জামায়াত এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছে এবং বলেছে যে, “এই আক্বিদার ‘প্রথমাংশ অর্থাৎ আল্লাহর একমাত্র ইলাহ হওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারুর ইলাহ না হওয়ার অর্থ এই যে, আকাশ ম-ল এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সেইসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, মা’বুদ এবং প্রাকৃতিক ও বিধিগত সার্বভৌম সত্তা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। এই সবের কোন একদিক দিয়েও কেউ তার শরীক নেই।” এর পর বলা হয়েছে যে, “এই মৌলিক সত্য কথাটি জানিয়া ও মানিয়া লইলে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো অনিবার্যরূপে গ্রহণ করিতে হয়।” এই অনিবার্য বিষয়গুলোর ৫ম বিষয়টির (৫ উপ-ধারা) ওপর নির্বাচন কমিশন আপত্তি উত্থাপন করেছে। এই উপ-ধারায় বলা হয়েছে, “আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারো নাই।

জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৩ নং ধারায় তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (স:) প্রদর্শিত দ্বীন (ইসলামী জীবন বিধান) কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

উপরোক্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম নি¤œরূপ হইবে :
(১) ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালানো।
ব্যাখ্যা : এখানে সার্বভৌমত্ব শব্দটি ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলামে আইনগত সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

(২) দায়িত্বশীল নাগরিক এবং চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন, ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন।

৩) সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন, জাতীয় আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনমান উন্নতকরণের মাধ্যমে শোষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।

(৪) ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সকল রাষ্ট্রর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৫ নং ধারাটি দাওয়াত সংক্রান্ত। এর আপত্তিকর উপ-ধারা ৩ এ যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে : “সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করে সমাজ থেকে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।”

সংগঠনটির গণতন্ত্রের ৬ নং ধারা হচ্ছে তার স্থায়ী কর্মসূচি সংক্রান্ত। এর অধীনে ৪টি উপ-ধারা আছে। আপত্তিকৃত চতুর্থ উপ-ধারায় বলা হয়েছে। “ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বর্ণিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।”

https://dailysangram.info/post/529536