১২ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১০:২৪

চোখের আলোয় স্বৈরাচারের পতন, সেফ এক্সিট ও গণতন্ত্রের সম্ভাবনা

মুজতাহিদ ফারুকী

আজ লেখার শুরুতেই পাঠকের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন- আচ্ছা, বলুন তো, অ্যাডলফ হিটলার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, প্রথম রাণী এলিজাবেথ এবং ভ্লাদিমির পুতিন- এদের মধ্যে মিল কী? একটা মিল তো সহজেই বলে দেয়ার মতো, তারা সবাই রাষ্ট্রনেতা। কেউ বিশাল সাম্রাজ্যের, কেউ বা রাষ্ট্রের। কিন্তু এর সাথে যদি আরেকটি নাম, বিল গেটস যোগ করি তখন কী বলবেন? বিল গেটস তো কোনো সাম্রাজ্যের বা রাষ্ট্রের নেতা নন!

একটি মিল বুদ্ধিমান পাঠক ঠিকই খুঁজে পাবেন। সেটি হলো, এরা সবাই স্বৈরাচারী বা অটোক্রেটিক নেতৃত্বের উদাহরণ। বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘ ৯ বছর কথিত স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম করে বিজয়ী হই ১৯৯০ সালে। স্বৈরাচার পতনের পর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল সব রাজনৈতিক দলের সমঝোতার ভিত্তিতে। কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের সেই ব্যবস্থাটিকে কেউ জঙ্গলের আইন বলেছেন, কিন্তু ব্যবস্থাটি যত দিন বলবৎ ছিল তত দিন এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে তথা নিজেদের পছন্দের সরকার বেছে নিতে পেরেছে। ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা, অর্থনীতিতে গতি ফেরানো, আইনের শাসন, সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটির বিকাশের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শিগগিরই আমরা সেই অর্জন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। দেখা গেল যারা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তারাই ক্ষমতার লোভে ওই পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে নতুন করে আঁতাত করেন। স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন করেন নিজের স্বার্থে। পরে এমন সময় আসে যখন স্বৈরাচারের নব্য পৃষ্ঠপোষকরা নিজেরাই সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। গণতন্ত্রের মূল রীতিনীতি আইনের শাসন উপেক্ষা করে মানুষের স্বাধীন সত্তার, স্বাধীন চলাফেরার ও মতপ্রকাশের সব অধিকার কেড়ে নেন। এমনকি বহু আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পর্যন্ত বাতিল করে দেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ সিভিল সোসাইটিকে উপেক্ষা, অপদস্ত, হয়রানি, ভয় দেখানো ইত্যাদি নানা কায়দায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারেরই অংশ। গত ১৫ বছরে বিরোধী দলের কী অবস্থা করা হয়েছে কারোরই অজানা নয়। ফলে একটি নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

দেশে এখন কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নতুন পর্যায় চলছে। সুতরাং একচ্ছত্রবাদী ব্যবস্থার চেহারা চরিত্র, তাদের বিদায়ের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এসব নিয়ে অনেকের মনে আগ্রহ আছে। সে জন্যেই আজ এ প্রসঙ্গে সামান্য বাক্যালাপ।

স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রসঙ্গটি কেবলই রাজনীতিবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একচেটিয়া আলোচ্য বিষয়, এমন কিন্তু নয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, গোষ্ঠী তথা ব্যবসায়-বাণিজ্যের বৃহত্তর অঙ্গনেও পরিচালন ব্যবস্থার বৈচিত্র্যের ধারায় স্বৈরাচারী স্টাইলের পরিচালননীতির প্রসঙ্গটি উঠে আসে। আমরা শুরুর প্রশ্নে রাষ্ট্রনেতাদের নামের সাথে পরে বিল গেটসের নাম যোগ করেছি এই প্রসঙ্গে আসার আভাস হিসাবেই। বিল গেটস মাইক্রোসফটের পেছনের চালিকাশক্তি হিসাবে ভীষণ কর্তৃত্ববাদী ছিলেন। তবে একই সাথে তিনি অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বের একটি মিশ্র শৈলী প্রয়োগ করেন যা তার কোম্পানিকে বিশাল সাফল্য এনে দেয়।

সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, যখন একজন নেতা কোনো দেশ বা বিশাল সাম্রাজ্য অথবা একটি গোষ্ঠী বা সংস্থার ওপর নিজের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তখন সেটাকেই বলা যায় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা।

কর্তৃত্ববাদী নেতারা সব সময়ই নিজের মতো করে একাই সব সিদ্ধান্ত নেন। অন্য কোনো নেতা, ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীর সাথে পরামর্শ করা বা তাদের বক্তব্য শোনার দরকার মনে করেন না। অবশ্য কর্তৃত্ববাদী হলেই কেউ স্বৈরাচারী হবেন এমনও নয়। ‘বেনিভোলেন্ট ডিক্টেটর’ বলে একটা কথা আছে, যেখানে একজন জনহিতৈষী একনায়ক রাষ্ট্রের বা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কল্যাণের লক্ষ্যেই সব সময় কাজ করেন।

আব্রাহাম লিঙ্কনের কথা বলা হয়, যিনি নিজে খুব কমই যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নেন একেবারেই স্বাধীনভাবে, নিজের মতো করে। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের মতে, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তার কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করেছিলেন। তার সেই কর্তৃত্ববাদী স্টাইলের নেতৃত্বের ফলাফল আমেরিকার ওপর গভীর, চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে। দাসত্বপ্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নিশ্চিত করে।

ফরাসি সামরিক নেতা নেপোলিয়নও তার স্বৈরাচারী নেতৃত্বের জন্য ছিলেন কুখ্যাত। বিশাল সেনাবাহিনীকে কমান্ড করার ক্ষেত্রে তিনি তার চিন্তাভাবনা অন্য কারো সাথে শেয়ার করতেন না। স্পষ্টতই, সে কৌশল কাজ করেছে। তিনি বিশাল ফরাসী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন।

কিন্তু সুপ্রাচীনকাল থেকে বিশ্ববাসী শাসিত হয়ে এসেছে মূলত স্বৈরশাসকদের হাতে। তারা যুদ্ধ করে দেশের পর দেশ দখল করেছেন, হত্যা করেছেন, লুণ্ঠন করেছেন এবং শাসন করেছেন। এখন একবিংশ শতাব্দী। এখন বিশ্বে শুধুই একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর নেই। এসেছে গণতন্ত্র নামের এমন এক রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থা যেখানে সাধারণ মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত জানানোর বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাও আছে। সেসব কারো অজানা নয়। আমাদের বলার কথা এই যে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই এ দেশে কখনোই স্বৈরাচারের জায়গা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। তা সে যতই ভুয়া উন্নয়নের কুমিরছানা দেখানো হোক না কেন।
আসুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে স্বৈরাচারের অবস্থা একটু দেখে নিই।

কোনো দেশে স্বৈরশাসকের পতন হলেই গণতন্ত্র আসবে এমন নয়। ১৯৫০ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের মধ্যে বিশ্বে যত স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এসেছে। তা সে পতন গণঅভ্যুত্থানে অথবা শাসকচক্রের ভেতরের লোকদের উত্থান অথবা অন্য যে কায়দায়ই ঘটে থাকুক না কেন। এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্রের আশা করার সুযোগ সচরাচর খুবই কম। ওই সময়ের মধ্যে বিশ্বে ৪৭৩ জন স্বৈরাচারী নেতা ক্ষমতা হারান। এগুলো ঘটেছে প্রধানত সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বে বিভক্তি (অভ্যুত্থান ইত্যাদি), জনবিদ্রোহ বা গণআন্দোলন এবং গৃহযুদ্ধ ও নিজ দফতরে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। বিশ্বজুড়ে ঘটনাবলির তথ্য বলছে, একনায়কের পতনের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আরেকজন একনায়ক ক্ষমতা দখল করেছে। তবে এটাও সত্য যে, কেবল গণঅভ্যুত্থানই পারে একনায়ক শুধু নয় বরং তার প্রতিষ্ঠিত পুরো শাসনপ্রণালী উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে।

আমেরিকার গোয়েন্দা মহলের বিশিষ্টজন Andrea Kendall-Taylor এবং ব্রিজওয়াটার স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর Erica Frantz ২০১৪ সালে রীতিমতো গবেষণা করে একখানা বড়সড়ো গবেষণাপত্র লিখেছিলেন মর্যাদাবান সাময়িকী The Washington Quarterly তে। তারাই এসব তথ্য উদ্ঘাটন করেন সারা বিশ্বের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে। ওই সময়কালে মানে ২০১৪ সালে বিশ্বের অন্তত ৬৫ দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ছিল যার অধীনে বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ শাসিত হচ্ছিল। সাময়িকীটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনীতি, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এসব গুরুতর বিষয় নিয়ে গভীর বিশ্লেষণমূলক কাজকর্ম করে।

যাই হোক, টাইলর ও ফ্রাঞ্জ তাদের How Autocracies Fall- শিরোনামের গবেষণাপত্রে বলেছেন, সচরাচর তিনভাবে স্বৈরাচারীদের পতন ঘটে। প্রথমত, অভ্যুত্থানসহ সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড এবং সমর্থন তুলে নেয়ার কারণে। দ্বিতীয়ত, জনবিদ্রোহ ও প্রতিরোধ তথা গৃহযুদ্ধসহ গণসংহতির মধ্য দিয়ে এবং তৃতীয়ত স্বৈরাচারীর স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫০-২০১২ পর্যন্ত, মাত্র ৭ শতাংশ স্বৈরাচারী নেতা জনবিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। উদাহরণ ১৯৭৯ সালে ইরানের শাহ, ১৯৯৩ সালে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট রাতসিরাকা, ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো এবং ২০১০ সালে কিরঘিজস্তানের প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক স্যালিয়েভিক বাকিয়েভ।

১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে প্রায় ৫০ শতাংশ স্বৈরাচারী ক্ষমতা হারান গণঅভ্যুত্থানে। তবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের সংখ্যা পরের দশকে ১০ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। এ নিয়ে কিছু মজার তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন দুই গবেষক। দেখিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হলে প্রায় ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়। এর বিপরীতে, সফল সামরিক অভ্যুত্থানে ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্রের সূচনা করেছে মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে। দেখা গেছে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। আরো বিশেষভাবে বললে, স্নায়ুযুদ্ধকালের আগে সঙ্ঘটিত ১৪১টি অভ্যুত্থানের মধ্যে মাত্র ৯টি ক্ষেত্রে (প্রায় ৬ শতাংশ) গণতন্ত্র পরিণতি পেয়েছিল; আর ১৯৯০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১৭টি অভ্যুত্থানের মধ্যে ৫টিতে গণতন্ত্রের সূচনা হয়।

স্বৈরশাসন ব্যর্থ হলে অর্থাৎ তার পতন হলে একটি দেশে সহিংসতার সম্ভাবনা কেমন থাকে সে বিষয়েও তথ্য বিশ্লেষণ করেন দুই গবেষক। তারা বলেন, স্বৈরশাসনের ব্যর্থতার পর কোনো দেশে কী মাত্রায় সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে তা নির্ভর করে দুটি ফ্যাক্টরের ওপর। ১. ক্ষমতা ছাড়ার পর স্বৈরশাসকের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শাসকের প্রত্যাশা বা অনুমান তাকে প্রতিবাদের মুখেও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কতটা সহিংসতার পথ বেছে নেবেন সেই বিবেচনার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ২. যেসব নেতা মনে করেন ক্ষমতা ছাড়লে তাকে হত্যা বা কারারুদ্ধ করা হবে তাদের পক্ষে সহিংসতার পথ বেছে নেয়ার সম্ভাবনা সেসব নেতার চেয়ে বেশি থাকে যারা শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় নিতে পারবেন বলে আশা করেন।

গবেষণায় বলা হয়েছে, পতনের পর চরম মূল্য দিতে হতে পারে এমন ঝুঁকিতে থাকা স্বৈরশাসককে ‘সেফ এক্সিট’ দেয়া হলে তার শান্তিপূর্ণ প্রস্থান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এদেশেও আন্দোলনরত একটি দল ক্ষমতাসীনদের সেফ এক্সিট দেয়ার কথা বলছে।
ই-মেল: mujta42@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/761495/