১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:১০

চাকরিটাই ‘জাদুর কাঠি’

যেখানেই জমি কিংবা ফ্ল্যাট কেনাবেচার হাওয়া, সেখানে ছোটেন জলিল মিয়া। পছন্দ হয়ে গেলে তাঁর কাছে দাম কোনো বিষয়ই না। তিনি বড় সরকারি কর্তা। পাবনার ফরিদপুরের বেরহাউলিয়া গ্রামের কৃষকপুত্র আবদুল জলিল মিয়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বরগুনা সার্কেলের সহকারী পরিচালক। সহকর্মীদেরই ভাষ্য, তিনি ‘টাকার কুমির’! রাজধানীতেই তাঁর আছে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও গাড়ি।

টাঙ্গাইল বিআরটিএর আরেক সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন। তিনি জলিল মিয়ার শ্যালক। দুলাভাই জলিলই শিখিয়েছেন ‘আলগা কামাই’র ধারাপাত! এর পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দুলাভাইয়ের মতো তিনিও হয়ে যান ‘টাকার মেশিন’।

বিআরটিএর রাজধানীর মিরপুর কার্যালয়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। ভাসানটেকের হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে ডিগ্রি নেওয়ায় নামের আগে লাগিয়েছেন ‘ডাক্তার’। মিরপুর এলাকায় তাঁর পরিচিতি ডা. আসাদুজ্জামান! সরকারি চাকরি করেই তিনি গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক।

মিরপুর অফিসেরই হিসাবরক্ষক খান মো. রুহুল আমিন এক কর্মস্থলেই খুঁটি ধরে আছেন প্রায় ১৩ বছর। বাড়ি, গাড়ি, জমি– কোনো কিছুতেই কমতি নেই। গ্রামের দরিদ্র স্বজনদের দুই হাতে টাকা বিলান। তাই গ্রামের লোকজনের বিশ্বাস জন্মেছে– রুহুল রাজধানীতে ‘টাকার খনিতে’ চাকরি করেন।

সবে অবসর-পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ের অফিস সহকারী রজব আলী মোল্লাও ঘুষবাজিতে কম যাননি। মিরপুর কার্যালয়ে রেকর্ডরুমে থাকাকালে টাকা ছাড়া নথি চিনতেন না। রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর তিনি যে ছয়তলা বাড়ি বানিয়েছেন, সেটির নাম ‘মোল্লা ভিলা’।

এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের ফিরিস্তিই বলে দেয় বিআরটিএর ঘুষ-বাণিজ্যের বিস্তার কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। ঢাকার প্রধান কার্যালয় তো বটেই, মাঠ পর্যায়েও সেবাগ্রহীতাদের কাছে হয়রানি, ভোগান্তি আর আতঙ্কের নাম বিআরটিএ। কথিত আছে, কার্যালয়ের ভেতরের টেবিল-চেয়ারও ঘুষ ছাড়া কিছু চেনে না! সরকারি মাশুলের বাইরে বাড়তি টাকায় সব কাজই মেলে সহজে। তা না হলে জুতার তলা ক্ষয় করেও হয় না কাজের সমাধান। বিআরটিএর ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া চাকুরেদের বিপুল বিত্তের খোঁজে ছিল সমকাল। তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়মের ওপর ভর করে উঠেছেন অবৈধ সম্পদের চূড়ায়। বিআরটিএর চাকরিটা তাঁদের কাছে ‘জাদুর কাঠি’। নইলে সরকারি চাকরির সামান্য বেতনে নামে-বেনামে এত অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়াটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।

বিশ্লেষকরাও বলছেন, বিআরটিএ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান– এটি মোটামুটি সবারই জানা। সেখানকার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপুল সম্পত্তির মালিক হবেন– এটাই স্বাভাবিক।

জলিল টাকার কুমির!
সহকারী পরিচালক আবদুল জলিল মিয়া ১৯৮৯ সালে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বিআরটিএতে যোগ দেন। এর পর ২০০৮ সালে হন মোটরযান পরিদর্শক। সেখান থেকে বছর দুয়েক আগে হয়েছেন সহকারী পরিচালক। এখন তাঁর বেতন ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে। মোটরযান পরিদর্শক থাকাকালে বেতন ছিল ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সে সময় থেকে তিনি গাড়ি হাঁকান, একাধিক বাড়ি করেন ঢাকার বুকে। তবে তাঁর সম্পত্তির বেশিরভাগই স্ত্রী মাহমুদা নাসরিনের নামে।

অনুসন্ধানে ঢাকায় তাঁর তিনটি বাড়ি, চারটি ফ্ল্যাট, একটি প্লট ও একটি প্রাইভেটকারের খোঁজ মিলেছে। গ্রামে জলিলের বাবার ছিল ছয় থেকে সাত বিঘা জমি। সেই জমি চাষ করে সংসার চালাতেন তিনি। ছয় ভাইয়ের মধ্যে জলিল মিয়া দ্বিতীয়। বিআরটিএর চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই বদলে যায় জলিলের জীবনের বাঁক। অবৈধভাবে উপার্জন করতে থাকেন টাকা। জলিলের আপন ছোট ভাই সাচ্চুও মিরপুর কার্যালয়ের দালাল। তবে দুই ভাইয়ের সম্পর্কটা এখন দা-কুমড়ো!

মিরপুর কার্যালয়ের উল্টো পাশে কয়েকশ গজ দূরেই তাঁর আলিশান বাড়ি। মোটরযান পরিদর্শক থাকাকালে কাফরুলের সেকশন ১৩-এর এ ব্লকের ১০/১ নম্বর লেনে সাততলা বাড়িটি নির্মাণ করেন। হোল্ডিং নম্বর ৪/১। প্রতি তলায় দুটি ফ্ল্যাট। তবে তিনতলায় দুটি ইউনিটে একসঙ্গে পরিবার নিয়ে বাস করেন জলিল। চারতলার একটি ফ্ল্যাটে তাঁর বেকার ছেলে নাজমুল হাসান নাইম সস্ত্রীক বাস করেন। অন্য সব ফ্ল্যাটে রয়েছে ভাড়াটিয়া। বাড়িটির কাছাকাছি একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে (প্লট নম্বর ৫৩, ৫৪, ৫৫) জলিল মিয়া সম্প্রতি চারটি ফ্ল্যাট সাড়ে চার কোটি টাকায় কিনেছেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। পুরো টাকা পরিশোধ হলেও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন এখনও হয়নি। গত ২৯ মে ওই ভবনে গিয়ে কথা হয় নির্মাণের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানান, তিনটি প্লট মিলে একটি ভবন করা হচ্ছে। জলিল মিয়া অষ্টম ও দোতলায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাকি দুটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত জানাতে পারেননি।

পশ্চিম ভাসানটেকের শ্যামল পল্লী আবাসিক এলাকায় জলিলের রয়েছে তিনতলা বাড়ি। সেটি দেখভাল করেন তাঁর মামাশ্বশুর অটোরিকশাচালক আলহাজ। গত ২২ মে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির গেটে কোনো হোল্ডিং নম্বর নেই। ৪/১৩ এন নম্বর হোল্ডিংয়ের পাশের বাড়ি এটি। বাড়ির গেটে টানানো টু-লেট। সেই মোবাইল নম্বরে কল করলে ফোন ধরেন আলহাজের স্ত্রী। ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন তাঁরা। ঘর ভাড়া নেওয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকলে তিনি জানান, নিচতলায় দুই পাশে মোট ১৪টি কক্ষ আছে। এ ছাড়া দোতলায় চারটি ও তিনতলায় চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। একটি ফ্ল্যাটে তাঁরা থাকেন, বাকি সব ভাড়া দেওয়া। বাড়িটির মালিক তাঁদের আত্মীয় আবদুল জলিল মিয়া বলে তিনি নিশ্চিত করেন।

পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকে (অ্যাভিনিউ-৫, জল্লাদখানার অদূরে) জলিলের তিনতলা আরেকটি বাড়ির হদিস মেলে। এটি দেখভাল করেন তাঁর ভাতিজির স্বামী ও বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের দালাল রতন। জলিলের মাধ্যমেই রতনের দালালির হাতেখড়ি। ১১ নম্বর সেকশনের তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় বাস করেন রতন।

গত ১৬ মে ওই বাড়িতে সরেজমিন গেলে কথা হয় ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে। বাড়িটির মালিক রতন– এটিই জানেন তাঁরা। আসল ঘটনা হলো, সরকারি কর্মকর্তার এত বাড়ি জানাজানি হলে বিভিন্ন সংস্থার নজরে পড়তে পারেন, এ কারণেই এই কৌশল নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি মিরপুরের পাইকপাড়ায় ১৩ শতাংশ জমি কিনেছেন জলিল। এ ছাড়া তাঁর আরও সম্পত্তি আছে বলে তথ্য মিললেও সেগুলোর যাচাই-বাছাই করা যায়নি।

এদিকে সম্পদের বিষয়ে সমকাল অনুসন্ধান চালাচ্ছে– এই তথ্য পেয়ে যান জলিল ও তাঁর ছেলে নাইম। এই প্রতিবেদকের নম্বর সংগ্রহ করে গত ১৭ মে ফোন দেন অচেনা এক ব্যক্তি। নিজেকে নাজমুল হাসান নাইম পরিচয় দিয়ে বলেন, কেন সম্পত্তির খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেদককে ‘দেখে নিতে’ চান তিনি। সম্পত্তি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে তাঁদের কিচ্ছু হবে না– এমন দম্ভোক্তিও করেন।

সরকারি চাকরি করে এত সম্পত্তির মালিক হলেন কীভাবে– এমন প্রশ্নে আবদুল জলিল মিয়া সমকালকে বলেন, ‘যদি আমার সম্পত্তি থাকে পত্রিকায় লিখে দেন।’

দুলাভাই জলিলের সঙ্গে আলতাফের সন্ধি
২০০৬ সালে জলিল যখন মিরপুর কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক ছিলেন, তখন শ্যালক আলতাফ একই পদে যোগ দেন। বছর পাঁচেক আগে পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি টাঙ্গাইলের সহকারী পরিচালক। চাকরি বাগানোর পর থেকেই টাকা কামাতে থাকেন কাঁড়ি কাঁড়ি। ঢাকায় আলতাফের দুটি বাড়ি ও একটি আড়াই কাঠা প্লটের তথ্য পেয়েছে সমকাল। পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ‘কে’ ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর প্লটে বানিয়েছেন ছয়তলা বিলাসবহুল বাড়ি। গত ৩০ মে সকালে সরেজমিন ওই বাড়ির বেজমেন্টে দেখা যায় ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-২৫২৫ নম্বরের একটি প্রাইভেটকার। গাড়িটি আলতাফের পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। তাঁর পরিবার থাকে ওই বাড়ির দোতলায়। অন্য তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট ভাড়া চলছে। আলতাফ প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে কর্মস্থল টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার বাসায় আসেন।

পশ্চিম ভাসানটেকের শ্যামল পল্লী আবাসিক এলাকায় আবদুল জলিলের তিনতলা বাড়ির তিনটি প্লট পরই আলতাফের তিনতলা বাড়ি। শ্যালক-দুলাভাইয়ের বাড়ি দুটি প্রায় একই নকশায় তৈরি।

২২ মে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় বাড়িটির ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে। এই বাড়িটিও দেখভাল করেন সেই অটোরিকশাচালক আলহাজ। তিনি আলতাফের মামা। ভাড়াটিয়ারা জানান, আলতাফের বাবা মোজাম্মেল হোসেন সরকার বাড়িটির মালিক। তবে পাবনার ফরিদপুরের সোনাহারা গ্রামে কৃষক মোজাম্মেলের পক্ষে ঢাকায় এত টাকায় বাড়ি বানানোর হিসাব কোনোভাবেই মেলে না। মিরপুরের জল্লাদখানা এলাকায় আলতাফের আড়াই কাঠার একটি প্লট রয়েছে। এর বাইরে আলতাফের আরও সম্পত্তি থাকলেও সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে পারেনি সমকাল।

এ ব্যাপারে আলতাফ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘বাপদাদার আছে, তাই করেছি। চাকরি করে কি সম্ভব? ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি গত মাসে। এলাকার রাস্তাঘাট ভালো না, তাই বিক্রি করে দিলাম।’ সমকালের অনুসন্ধান বলছে, বাড়িটি তিনি বিক্রি করেননি।

সম্পত্তি লুকাতে আসাদুজ্জামানের স্ত্রী ঢাল
বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান চাকরি করেই গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চোখ ফাঁকি দিতে গাড়ি ও জমি কিনেছেন স্ত্রীর নামে। স্ত্রীর নামেও গোঁজামিল। কোথাও তানভীর আক্তার, আবার কোথাও তানভীন আক্তার লেখা।

অনসুন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, পল্লবীর পলাশনগরে ৫৯/২০/বি হোল্ডিং নম্বরে রয়েছে আসাদুজ্জামানের ১০ কাঠা জমির ওপর একতলা ভবন। এটি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে গুদামঘর হিসেবে ভাড়া দেওয়া। দেয়ালে ছোট সাইনবোর্ড সাঁটানো। তাতে লেখা– তানভীর আক্তার, স্বামী ডা. আসাদুজ্জামান। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, আসাদুজ্জামান প্রথমে পাঁচ কাঠা জমি কেনেন। পরে আরও পাঁচ কাঠা জমি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় কিনে গুদামঘর করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।

কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের মুন্সীবাড়ি সড়কের একটি আলিশান ভবনে নিজের কেনা ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বাস করেন আসাদুজ্জামান। গত ১৬ মে ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, গ্যারেজে একটি এক্স নোয়া (ঢাকা মেট্রো-চ-২০-৩২৩২) গাড়ি। এটির দাম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে গাড়িটি কেনা। এখানে স্ত্রীর নাম রয়েছে তানভীন আক্তার। গাড়ি-সংক্রান্ত কাগজপত্রে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ইব্রাহিমপুর কামাল খান সড়কের ৬৩৪/১ নম্বর বাড়ির। ওই বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চারতলা বাড়ির তিনতলায় আসাদুজ্জামানের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

আসাদুজ্জামান মিরপুর কার্যালয়ে বদলি হয়ে আসার আগে বিআরটিএর সদরদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি শাখার উচ্চমান সহকারী ছিলেন। সে সময়ের বিআরটিএর একজন চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। সে সময় নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারে আমার হোমিওপ্যাথি চেম্বার ছিল। চাকরির পাশাপাশি সেখানে রোগী দেখতাম। এখন চেম্বারে বসি না। দক্ষিণখান এলাকায় আমার শ্বশুর আমার স্ত্রীকে জমি দিয়েছিলেন। সেটি বিক্রি করে পলাশনগরে স্ত্রীর নামে জমি কিনেছি। এ ছাড়া যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেটি আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছোট ভাইয়ের কেনা। তার ফ্ল্যাটে আমি থাকি। গাড়িটি ব্যাংক ঋণ নিয়ে কিনেছি।’

টাকার ‘খনিতে’ চাকরি করেন রুহুল আমিন
মিরপুর অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসাবরক্ষক খান মো. রুহুল আমিনের সাকল্যে বেতন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এই বেতনেই নিজ গ্রামে আলিশান বাড়ি দাঁড় করিয়েছেন। শরীয়তপুরের জাজিরার মুন্সিকান্দিতে তাঁর বাড়ি। সেখানে প্রায় ১৫ কাঠা জমির ওপর দোতলা একটি বাড়ি করেছেন। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ৮ থেকে ১০ বছর আগে বাড়িটি করা হয়। এ ছাড়া গ্রামে অনেক জমি কিনেছেন। রুহুল আমিনের বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন দরিদ্র। তাঁদের দুই হাতে দানও করেন তিনি। দুই আত্মীয়কে ইতালি যাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। গ্রামের লোকজনের ভাষ্য, ‘মনে হয় রুহুল টাকার খনিতে চাকরি করে। চাকরির পর জমি-জায়গা-বাড়ি অনেক কিছুই করেছে।’
খান রুহুল আমিন বলেন, ‘থাকার জন্য গ্রামে বাড়ি করেছি।’

অফিস সহকারী রজবের ছয়তলা বাড়ি
রজব আলী মোল্লা এমএলএসএস হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে হন অফিস সহকারী। সর্বশেষ বিআরটিএ সদরদপ্তরে ছিলেন। তিনি এখন অবসর-পরবর্তী ছুটিতে আছেন। দীর্ঘদিন বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে রেকর্ডরুমে দায়িত্ব পালন করেন। যখন এমএলএসএস ছিলেন, তখনই তিনি ঢাকার পূর্ব কাজীপাড়ায় ছয়তলা বাড়ির মালিক। গত ২৩ ডিসেম্বর ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ‘টু-লেট’ ঝুলছে প্রধান ফটকে। বাসা ভাড়া নেওয়ার অজুহাতে কথা হয় রজব আলীর সঙ্গে। জানালেন, ছয়তলা বাড়িটির মালিক তিনি। ১০-১২ বছর আগে পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। নিচতলা বাদে প্রতি ফ্লোরে চারটি করে ইউনিট। দুই ইউনিট একসঙ্গে করে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন, আর বাকিগুলো ভাড়া চলছে।
গতকাল বিকেলে রজব আলী মোল্লার মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি। তবে গত ২৩ ডিসেম্বর তিনি জানিয়েছিলেন, কাফরুলের বাড়িটি অনেক কষ্টে তৈরি করেছেন।

কারা কী বলছেন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, বিআরটিএর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এটি একটি সিন্ডিকেট। তাঁরাই তো সম্পত্তির মালিক হবেন। তাঁদের সঙ্গে আরও যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাঁরা অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন, এটি একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খাঁন সমকালকে বলেন, দুদক যদি কোনো ব্যক্তির অবৈধ আয় এবং অবৈধ সম্পত্তির তথ্য পায়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়। বিআরটিএর অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের তথ্য যাচাই করেছি এবং ভবিষ্যতে করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেন, ‘কার কী সম্পদ আছে, সেটা আমি কীভাবে জানব।’
এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সমকালকে বলেন, কর্মচারীদের সম্পদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে সেটা আমরা খতিয়ে দেখি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আয়কর নথি জমা দেওয়ার পর সেই তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ যাচাই করে। আমাদের তরফ থেকে কোনো যাচাই করা হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্পদের বিষয়ে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে, সেটা আদালতে নিষ্পন্ন হবে।

 

https://samakal.com/bangladesh/article/2307182607