১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:০৮

রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। তাই মেঝেতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। গতকাল তোলা।

দেশে এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক ও হাসপাতাল ঘুরে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা দ্বিগুণ হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৮৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আরো তিনজন মারা গেছে।

এর মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাঁরা হলেন হাজারীবাগ থানার কনস্টেবল রাসেল ও গেণ্ডারিয়া থানার নারী কনস্টেবল আয়েশা আক্তার।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) এ কে এম হাফিজ আক্তার এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ডিএমপির অর্ধশতাধিক সদস্য রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

দেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।

গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৭৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যাল, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো সিট খালি। অর্থাৎ রোগী বাড়লেও এখনো তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা অন্যান্য হাসপাতালের পাশাপাশি মহাখালী ডিএনসিসি কভিড-১৯ হাসপাতালেও রোগী ভর্তি করেছি।

প্রয়োজনে ওই হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করে দেওয়া হবে।’
তবে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রক্তের বিপুল চাহিদা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দাতা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্লাড সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) নুর আলম সবুজ কালের কণ্ঠকে বলেন, গত এক সপ্তাহে রোগীর ডোনার থেকে ব্লাড সংগ্রহ করা হয়েছে ২০০ ইউনিট। প্লাটিলেট কনসেনট্রেট ও এফারেসিস প্লাটিলেট মিলিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে ১২০ ইউনিট, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি এবং তা মোট চাহিদার ২০ শতাংশ।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তা ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাটিলেটের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে।
এক ইউনিট প্লাটিলেট কনসেনট্রেটের জন্য চারজন ডোনার প্রয়োজন, যা অনেক রোগীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। আবার এফারেসিস প্লাটিলেটের (একজন থেকে এক ইউনিট) জন্য ভালো ডোনার পাওয়াও যায় না। এর খরচ বেশি হওয়ায় সবার এটি করার সামর্থ্য নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের কাউন্সিলর ও সমন্বয়ক সুব্রত বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৮৫ থেকে ৯০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়েছে ১৫ ইউনিট, যা গত কয়েক মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর স্বজনরাই বেশি আসছে প্লাটিলেট ও রক্তের জন্য।

এ ছাড়া বাঁধন, কোয়ান্টাম, পুলিশ ব্লাড ব্যাংক, সন্ধানী ব্লাড ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, প্লাটিলেট ও রক্তের জন্য প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজারের বেশি কল আসছে। কিন্তু রক্তদাতা না থাকায় চাহিদা ২৫ শতাংশের বেশি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেজ্ঞরা বলছেন, রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা দিলে এবং প্লাটিলেট কাউন্ট ২০ হাজারের নিচে নামলে অথবা রক্তক্ষরণ নেই কিন্তু প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে, তবেই প্লাটিলেট দেওয়ার কথা ভাবা হয়।

তিনজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৮৮৯ জন : দেশে গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো তিনজন মারা যাওয়ায় চলতি বছর এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৭৬-এ পৌঁছল। এই সময়ে আরো ৮৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট তিন হাজার ২৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে এক হাজার ১৭৩ জন ঢাকা বিভাগের বাইরের। নতুন রোগীদের নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ১৩ হাজার ৮৪৩ জন।

মৃত্যু বেশি শক সিনড্রোমে : চলতি বছর ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা নিয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, রোগীরা অনেক দেরিতে চিকিৎসার জন্য আসছে। এতে দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, কিন্তু সবাইকে রক্ত আর প্লাটিলেট দিতে হচ্ছে না। রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে এমন রোগী একেবারে কম।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এ পর্যায়ে রোগীর পালস, রক্তচাপ কমে যায়, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। এতে রোগীর মস্তিষ্ক, হার্ট, কিডনি, লিভারের মতো অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় আসা রোগীদের বাঁচানো অনেক কঠিন। তখন রোগীদের আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়।

‘প্লাটিলেট কমে রোগী মৃত্যুর ঘটনা নেই’ : অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অনেক ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের ধারণা, প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তপাত হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। আসলে এটা ভুল। প্লাটিলেট বা রক্তের কারণে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা তেমন নেই। প্লাটিলেট কমলে শরীরে এক ধরনের মাইনর ক্যাপিলারি ব্লিডিং হয়। এতে রোগী মারা যায় না। রোগী মারা যায় শক সিনড্রোমে।

কখন প্লাটিলেট প্রয়োজন হয় : অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, যদি এমন হয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্লাটিলেট কমে গেছে, কিন্তু অন্য কোনো রোগে তাঁর জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে রোগীর প্লাটিলেট প্রয়োজন হয়। যেমন—সন্তানসম্ভাবনা কোনো নারীর সিজার করতে হবে, কিন্তু তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং প্লাটিলেট কম রয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাঁর প্লাটিলেটের দরকার হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ডেঙ্গু রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়ার নির্দেশনা খুব একটা নেই। যদি কারো প্রয়োজন হয়, তাহলে রক্ত দেওয়ার কথা বলা আছে গাইডলাইনে।

জরুরি ও গুরুতর রোগীদের জন্য হাসপাতাল : সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান—আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, শয্যাসংকটের কারণে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। তাই এখন প্রয়োজন হলো প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা, যাতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল জরুরি ও গুরুতর রোগীদের জন্য থাকে।

ডিএনসিসির অভিযানে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা : এডিস মশা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন—ডিএনসিসির মাসব্যাপী বিশেষ অভিযানের তৃতীয় দিন গতকাল সোমবার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। মামলা হয়েছে ১৬টি।

অভিযানের সময় সরকারি-বেসরকারি সাতটি ভবনের বেইসমেন্টে পরিদর্শন করে পাঁচটিতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই যদি বেইসমেন্টে এভাবে মশার চাষ করা হয়, তাহলে আমরা কিভাবে সফলতা পাব?’

সকাল ১১টায় মশক নিধন বিরোধী অভিযানে কারওয়ান বাজারে একুশে টিভি ভবনে (জাহাঙ্গীর টাওয়ার) মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ভবন কর্তৃপক্ষকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া লার্ভা পাওয়ায় টিসিবি, বিটিএমসি ও যমুনার নির্মীয়মাণ ভবনকে একই অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়।

ডিএসসিসির অভিযানে ২৩ স্থাপনাকে জরিমানা : এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন—ডিএসসিসি পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বাংলাদেশ আই হসপিটালের ধানমণ্ডি শাখা ও কনকর্ডের নির্মীয়মাণ ভবনসহ মোট ২৩টি স্থাপনার মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২৩টি মামলায় দুই লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/11/1297494