১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:৪১

৮ বছরে মশার পেটে ৪৪৪ কোটি টাকা


মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ওষুধ ও সংশ্লিষ্ট খাতে গত ৮ বছরে ৪৪৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ ছিটাচ্ছে। তারপরও প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫-৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে শ’ শ’। বর্তমানে এমন অবস্থা যে সর্বত্রই ডেঙ্গু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নেই মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে সিটি কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর সাথে জনগণকেও সচেতন ও সম্পৃক্ত হতে হবে।

রাজধানীতে মশা একটি অন্যতম সমস্যা। দিনে রাতে সমানতালে চলতে থাকে মশার উপদ্রব। শীত কি গ্রীষ্ম সব সময়ই মশার কামড় সহ্য করতে হয় নাগরিকদের। মশারি ছাড়া ঘুমানোর কথা চিন্তাও করা যায় না। তবে শুধু কামড়ই নয় বর্ষাকাল আসলেই শুরু হয় নতুন অত্যাচার। অন্যান্য সময় কিউলেক্স মশার উপদ্রব চললেও এ সময় প্রাণঘাতী এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। এই দুই ধরনের মশার জন্মস্থলও সাধারণত দুরকমের হয়ে থাকে। কিউলেক্স মশা খাল-নালার ময়লা পানিতে জন্ম নেয়। আর এডিস মশার জন্ম হয় পরিষ্কার পানিতে। যা ঘরের মধ্যেও থাকতে পারে।

মশার এ অত্যাচার থেকে নাগরিকদের রক্ষায় সিটি করপোরেশন সারা বছরই ময়লা পানিতে থাকা লার্ভা মারতে সকালে তরল ওষুধ এবং পরিণত মশা মারতে বিকেলে বাসাবাড়ির আশপাশে ফগিং (ধোয়া ) করে থাকে।

জানা যায়, মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত আট বছরে মোট ৪৪৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ব্যয় করেছে ৩০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ব্যয় করেছে ১৪৩ কোটি টাকা।

ডিএনসিসি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশা মারতে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাড়ে ১৭ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে ১৭ কোটি টাকা, ১৯-২০ অর্থবছরে ৫৮ কোটি টাকা, ২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ৫০ কোটি টাকা, ২১-২২ অর্থবছরে ৫৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ও বর্তমান ২২-২৩ অর্থবছরে খরচ ধরা হয়েছে ৭৬ কোটি টাকা।

ডিএসসিসি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশা মারতে ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা, ১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০-২১ অর্থবছরে ১৯ কোটি টাকা, ২১-২২ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা ও বর্তমান ২২-২৩ অর্থবছরে খরচ ধরা হয়েছে ২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: ফজলে শামসুল কবির গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে তা মানসম্মত এবং দু’টি ল্যাবে পরীক্ষা করে ৯৮ ভাগ কার্যকারিতা থাকার পর ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা বাড়ির বাইরের মশা মারছি এবং এতে সফলও হচ্ছি। কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য দায়ী যে এডিস মশা তা মানুষের ঘরে, বাড়ির ছাদে, বাথরুমের বালতিতে জন্মাচ্ছে। এগুলোতো আমরা মারতে পারি না। এগুলো না হওয়াতে ওই বাসায় থাকা ব্যক্তিদের সচেতন হতে হবে। তারা যদি নিয়মিত পানি ফেলে দেন তাহলে আর মশা হয় না। এছাড়া নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে সেখানে মশা হচ্ছে। স্কুল-কলেজে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় না। সেখানে মশা থাকায় এবার শিশুরাও মারা যাচ্ছে। ডিএসসিসি এলাকার ২৮টি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আমরা এর সাথে আরো দু’টি ওয়ার্ড মিলিয়ে ৩০টি ওয়ার্ডে বিশেষ চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি। আমরা আমাদের যে প্রচেষ্টা তা অব্যাহত রেখেছি। এছাড়া আমরা ২২টি সংস্থাকে নিয়ে গত মে মাসে সভা করেছি, তাদের আবার চিঠি দিয়েও সচেতন করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা সৃষ্টিতে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু সবাই সচেতন না। এ কারণেই জনগণকে ভুগতে হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব একা সিটি করপোরেশনের না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটা সবাইকে নিতে হবে। এই শহর আমাদের সবার। এই শহরটাকে সবাইকেই ভালোবাসতে হবে। ভবনের ভেতরে বেজমেন্টে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এ বেজমেন্ট পরিষ্কার করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয় উল্লেখ করে মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাথ এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করছে। কিন্তু অফিসের, মার্কেটের ও বাড়ির বেজমেন্ট পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব ভবন মালিক বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। সবাই যার যার প্রতিষ্ঠান, ভবন পরিষ্কার রাখলে আমরা এডিস মশা থেকে অনেকখানি রক্ষা পেতে পারি। এতে করে শহরবাসীও রক্ষা পাবেন। সামনে ঢাকার পরিস্থিতি আরো ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে বলেও জানান মেয়র।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার নয়া দিগন্তকে বলেন, এডিস মশা শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে মারা যায় না। এজন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সারা বছরব্যাপী এ কাজ করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, করোনার সময় জনগণ যেভাবে নিজেরা সচেতন হয়, হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন নিয়ম মানতে শুরু করে। ঠিক সেভাবে এখন জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, জনগণ এখন সবকিছু জানে। তারা সচেতন, কিন্তু সম্পৃক্ত হচ্ছে না। তাদের মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/761332/