১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:৩৮

৩ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে

গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ৮৮৯ : মৃত্যু ৩

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা। সামনে হয়তো হাসপাতালে আর ভর্তি করা যাবেন জরুরিভিত্তিতে সিট না বাড়ালে। গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত দেশে তিন হাজার ২৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন ছিল সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। ঢাকা ডেঙ্গুর হটস্পট হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের চাপ এখানেই বেশি। রাজধানীর বাসিন্দা ছাড়াও ঢাকার বাইরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মুমূর্ষু রোগীরা ভর্তি হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, গত জুন মাসের ৩০ দিনে যতো ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে জুলাই মাসের গত ১০ দিনেই তা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। জুন মাসে দেশে মোট ৫ হাজার ৯৫৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। অন্যদিকে জুলাইয়ের গত ১০ দিনে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৮৬৫ জন।

গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে ৮৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। একই সময়ে ডেঙ্গুতে দেশে ৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জিন্সি অ্যান্ড কনট্রোল রুম।

গত ২৪ ঘণ্টায় যে ৮৮৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে ৫৭৪ জনই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাকি ৩১৫ জন ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে যাদের মুমূর্ষু অবস্থা তারা শেষ পর্যন্ত ঢাকায় চলে আসছেন চিকিৎসা নিতে।

হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটের চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে শেষ অবস্থায় যখন চিকিৎসায় কিছু করার থাকে না। ফলে, যা হওয়ার তাই হচ্ছে অর্থাৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা: যুবায়ের জানান, ডেঙ্গু হয়েছে পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েই চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে থেকেই ডেঙ্গু চিকিৎসা করা সম্ভব। তিনি বলেন, চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে যেতে না পারলে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরতো সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে যেতে পারলে কিছু চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়ার সাথে সাথে কিছু ওষুধও পাওয়া যায় বিনামূল্যে। এই সুযোগটি সবার নেয়া উচিত। সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তার দেখাতে পারলে সেই হাসপাতালেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও খুব স্বল্পদামে করা যায়। ডা: যুবায়ের বলেন, তাছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, লেবুর শরবত এবং খাবার স্যালাইন খেয়ে গেলেও রোগী খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বেন না। বরং এই পরামর্শ মেনে চললে রোগী এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাবেন, এটা পরীক্ষিত একটি পরামর্শ। আর জ্বর অথবা শরীর ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খেয়ে যেতে হবে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগীর অবস্থা তখনই খারাপ হয় যখন পরীক্ষা না করেই ডেঙ্গুর প্রথম দিকেই দ্রুত সুস্থ হয়ে যেতে অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করে দেন। সবার জানা উচিত যে, ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গুর পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনের অবহেলা দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্ট অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু শুরু হওয়ার আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা জরিপ করে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই হুঁশিয়ারি কানে তোলেনি। সেই মে-জুন মাস থেকেই ব্যাপক ভিত্তিতে ঢাকায় মশক নিধন অভিযান জোরদার করতে পারলে ডেঙ্গু এতো ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারতো না। ফলে ডেঙ্গু শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের প্রায় সবগুলো জেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখনো সময় আছে, বিদেশ থেকে দ্রুত কার্যকর ওষুধ নিয়ে এসে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, জুলাই মাসের গত ১০ দিনেই জুন মাসের ৩০ দিনের আক্রান্তের সমান রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর বাইরেও অনেক রোগী আছে যারা হাসপাতালে ভর্তি হতে পছন্দ করেন না। তারা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যান; কিন্তু এসব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে থাকে না।

পটুয়াখালীতে নতুন ৩৫ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি : পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অপরিবর্তি রয়েছে। গত দুই দিনে নতুন ৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। ত্রিশোর্ধ্ব এক গৃহবধূ পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসারত আছেন। এই হাসপাতালে স্থাপিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে নতুন চারজন ভর্তি এবং দুই শিশুসহ ১৬ জন চিকিৎসারত আছে বলে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা।

গতকাল সোমবার পটুয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের দেয়া তথ্য সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ৮টা থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে নতুন ৪ জনসহ জেলায় ৩৫ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ১৮ জন, বাউফলে ৪ জন, দুমকীতে ১ জন, গলাচিপায় ১ জন। পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৬ জনসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসারত আছে বলে সিভিল সার্জন ডা: এস এম কবির হাসান জানান। চিকিৎসারত ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ৬ জন, দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ৩৭ জন, গলাচিপায় ১ জন, কলাপাড়ায় ৪ জন ও দুমকী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ৪ জন। গত জানুয়ারি হতে এ পর্যন্ত (১০ জুলাই) জেলায় ১৯৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল এবং ১৩৮ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলেও সিভিল সার্জন এ প্রতিনিধিকে জানান।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের গৃহবধূ নিলুফা বেগম ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭ জুলাই ভর্তি হয়। তার অবস্থা আশ্ঙ্কাজনক হলে ৮ জুলাই তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের ও নার্সদের চিকিৎসাসেবায় অনেকটা সুস্থ হচ্ছেন বলে গৃহবধূর স্বামী মোতালেব হাওলাদার জানান।
এদিকে ডেঙ্গু প্রকোপ বৃদ্ধির খবরে পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ মশা নিধনে মাঠে নেমেছেন। তিনি ৯ জুলাই বিকেল ৩টায় পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ এলাকার বিভিন্ন স্থানে ফগার মেশিন দিয়ে মশা নিধন ওষুধ স্প্রে করে ডেঙ্গু মশা নিধন কার্যক্রম শুরু করেন।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। তবে গত ১০ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। বিকেলে গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা: মো: খায়রুজ্জামান এ তথ্য জানিয়েছেন।

সিভিল সার্জন মো: খায়রুজ্জামান জানান, গাজীপুরে ক্রমশ বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। রাজধানী ঢাকা সংলগ্ন শিল্পাঞ্চল টঙ্গীতে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে গত ১০ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯২ জন। বর্তমানে এ রোগে আক্রান্ত ৩২ জন জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরমধ্যে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে ২০ জন ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সর্বশেষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ৭৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে গত ১০ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি।

তিনি জানান, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে ও মোকাবেলায় জেলায় নানা প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতার জন্য আমরা লিফলেট বিতরণ, কাউন্সিলিং ও অবহিতকরণ সভার মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছি। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর জন্য হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধসহ অতিরিক্ত বেড ও কর্ণার স্থাপন করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবেলায় সোমবার বিকেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক এমপির সাথে সচেতনতামূলক জুম মিটিং হয়েছে। এর আগে রোববার স্বাস্থ্য সচিবের সাথে সচেতনতামূলক অপর একটি জুম মিটিং হয়েছে।

এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য ৭৫ ড্রাম ওষুধ, ২৫ হাজার পিস ট্যাবলেটসহ অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুত রয়েছে। যা আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পৌঁছে দেয়া হবে। যা ফগার মেশিন দিয়ে ওয়ার্ডগুলোর বিভিন্ন স্থানে ছিটানো হবে।


https://www.dailynayadiganta.com/first-page/761346/