১১ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:৩৩

আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে সংবিধান কি বলে

ইকতেদার আহমেদ

বাংলা ‘চুক্তি’ শব্দটির ইংরেজি Contract আবার Contract এর সমার্থক ইংরেজি শব্দ Agreement, Pact, Treaty প্রভৃতি। Agreement এর বাংলা অর্থ চুক্তি, মত, মিল, সম্মতি, সমঝোতা, ঐকমত্য, বোঝাপড়া প্রভৃতি। আইনের ভাষায়-সব ধরনের সমঝোতাই চুক্তি যদি তা চুক্তি সম্পাদনে যোগ্য পক্ষের স্বাধীন সম্মতিতে আইনসঙ্গত মূল্য এবং বিষয়ে হয় যা ব্যক্তভাবে বাতিল ঘোষিত নয়।

নিজ দেশের কোনো আইন দ্বারা বারিত নন এমন প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদনের যোগ্য। স্বভাবত প্রশ্নের উদয় হতে পারে চুক্তি সম্পাদন বিষয়ে সুস্থ মস্তিষ্ক বলতে কি বুঝায়? এ বিষয়ে আইনজ্ঞদের সুচিন্তিত অভিমত- চুক্তি সম্পাদন বিষয়ে একজন ব্যক্তিকে তখন সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ভাবা হয়; যদি এটি সম্পাদনকালে তিনি এর অর্থ বুঝতে এবং তার স্বার্থের ওপর এটির প্রভাব বিষয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম।

সম্মতি ও স্বাধীন সম্মতি এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যখন একই অনুভূতিতে একটি বিষয়ের ওপর সম্মত হন; তখন এটিকে সম্মতি বলা হয়। অন্যদিকে সম্মতি তখনই স্বাধীন যখন এটি প্রদান বিষয়ে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ বা অন্যায় প্রভাব বা প্রতারণা বা ভ্রমাত্মক উপস্থাপন বা ভুল না থাকে।

একটি রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়; তাকে বলা হয় আন্তর্জাতিক চুক্তি। আমাদের ’৭২-এর সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক কোনো বিধান ছিল না। পরবর্তীতে সামরিক ফরমানবলে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৪৫ক সন্নিবেশনকরত আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে বিধান প্রণীত হয়। ওই অনুচ্ছেদটিতে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে- বিদেশের সাথে সম্পাদিত সব চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হবে।

সামরিক ফরমানবলে সংবিধানে প্রণীত সংশোধনীগুলো সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা পরবর্তী অনুচ্ছেদ ১৪৫ক কার্যকারিতা হারায়। ইতোপূর্বে আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করায় দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে এমন বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কারণে সংবিধান নতুনভাবে সংশোধিত হওয়ার আবশ্যকতায় সামরিক ফরমানবলে প্রণীত সংশোধনীসমূহের ঠাঁই সংবিধানে হবে না। কিন্তু পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ফলে প্রবর্তিত পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন পরবর্তী দেখা গেল সংবিধানে আগেকার ন্যায় অনুচ্ছেদ ১৪৫ক বহাল রয়েছে।

একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের পক্ষে কোন পদমার্যাদার ব্যক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে যখন সীমানা বিরোধ মীমাংসাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন রাষ্ট্রদ্বয়ের শীর্ষ নির্বাহী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে থাকেন। আবার দু’টি রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় অথবা মন্ত্রণালয়স্থ বিভাগ বা সংস্থার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা সচিব অথবা বিভাগ বা সংস্থার প্রধান চুক্তিতে স্বাক্ষর করে থাকেন।

১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ওই চুক্তিটিতে ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তিটি স্বাক্ষরকালীন আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করার বিধান না থাকলেও চুক্তিটিতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভূমি ও ছিটমহল বিনিময়সহ স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তা সংসদে পেশ করে সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চুক্তিটি সংসদ দ্বারা অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারতের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন এলাকা কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে সে ক্ষেত্রে তা সংসদ দ্বারা অনুমোদনের আবশ্যকতা নেই; তবে অনুরূপ চুক্তি অনুযায়ী ভারতের অন্তর্ভুক্ত কোনো এলাকা অন্য কোনো রাষ্ট্রকে প্রদান বা অপর কোনো রাষ্ট্রের সাথে বিনিময় করতে হলে তাতে সংসদের অনুমোদনের আবশ্যকতা রয়েছে। এ আবশ্যকতাসহ ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্থলসীমানা বিরোধ বিষয়ে তথাকার আদালতে মামলা হওয়ার কারণে ভারত কর্তৃক স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর ৪১ বছর বিলম্বিত হয়।

বাংলাদেশের সাথে ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কয়টি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সে বিষয়ে দেশবাসীর কোনো ধারণা নেই। বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রের যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ আইন ও বিচার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্যক ধারণা থাকার কথা।

দেশের যেকোনো নাগরিক এসব চুক্তি বিষয়ে উপরোল্লিখিত মন্ত্রণালয়সমূহ হতে তথ্য জানতে চাইলে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তা জানানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপরোক্ত মন্ত্রণালয়সমূহ হতে অপারগতা প্রকাশ করা হয় বা যতটুকু তথ্য দেয়া হয় তা চুক্তির বিষয়বস্তু জানার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়।

আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে আমাদের সংবিধানের যে বিধান তাতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট চুক্তি সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ ব্যতীত অপরাপর চুক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার পর রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন।

আমাদের সংবিধানে দু’টি ক্ষেত্র যথা প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা কার্যকর থাকাকালীন বিধানটি প্রযোজ্য। আমাদের দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হওয়াকালীন রাষ্ট্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকায় অনুরূপ চুক্তি সংসদে পেশের ক্ষেত্রে তার জন্য অন্য কারো বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা ছিল না।

আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করার বিধান বহাল থাকাকালীন আমাদের দেশ রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় পদ্ধতি উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৫ক আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করার বিষয়ে যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে তা কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া অথবা উপেক্ষা বা অবজ্ঞা বা অমান্যের অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক বিধানটি সন্নিবেশন পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া পরবর্তী সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করে সে সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়নি।

সংসদ সদস্যরা একটি নির্বাচনী এলাকার বিপরীতে ওই নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। এরূপ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদে দেশের সব এলাকার জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। সংসদে যেকোনো বিষয়ে আলোচিত হলে তা দেশের সব নাগরিকের জানার অবকাশ ঘটে। যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি দেশের স্বার্থের অনুকূলে নাকি প্রতিক‚লে প্রণীত সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে পেশ করার বাধ্যবাধকর বিধানের প্রবর্তন। আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে এরূপ বাধ্যবাধকর বিধান থাকা সত্ত্বেও তা সংসদে পেশ না করা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন। এ লঙ্ঘনের দায় কার ওপর বর্তায় তা অনুচ্ছেদ ১৪৫ক ও অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এর বিধানাবলি অবলোকনে বিচার, বিবেক ও বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো জনমানুষের পক্ষে অনুধাবন সম্ভব। এ ধরনের দায় বিশিষ্ট কেউ যদি অতীতে যাদের ওপর দায় ছিল তারা এটি অনুসরণ করেননি এ কথা বলে এ ধরনের দায় হতে নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস নেয় বাস্তব অর্থে তা কোনোভাবে নিষ্কৃতি দেয় না। সুতরাং সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধান মেনে চলার মধ্যে নিহিত রয়েছে আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়বস্তু সংসদে পেশ করে জনমানুষের জানার অবকাশ ঘটিয়ে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সার্থকতা।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/761227/