১০ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১০:৫৬

হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ

ঘুষ নিয়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ার একাধিক অডিও রেকর্ড

জুনের শেষ দিকে এভাবেই শাল্লায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকে।
সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষায় চলতি বছর প্রায় ২০৪ কোটি টাকার বাঁধের কাজ হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষের চূড়ান্ত প্রতিবেদন (পোস্ট-ওয়ার্ক) তৈরি করেছেন বাঁধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠা সেকশন অফিসার (এসও) ও সার্ভেয়াররাই।

কৃষকদের অভিযোগ, অপ্রয়োজনীয়, অক্ষত, অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে বরাদ্দ দিয়ে কাজের আগে প্রাথমিক প্রতিবেদন (প্রি-ওয়ার্ক) করেছিলেন যে এসও ও সার্ভেয়াররা, তাঁরাই পোস্ট-ওয়ার্ক করে বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এভাবে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ায় সরকারের প্রায় ৫০ কোটি টাকা অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে উৎকাচ নিয়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ার একাধিক অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছেও এসেছে। এরই মধ্যে এক এসওকে বদলিও করা হয়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে উপজেলা থেকে পোস্ট-ওয়ার্কের প্রতিবেদন জেলা অফিসে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো জেলা কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়ে কোনো বৈঠক করতে পারেনি।

২০১৮ সাল থেকে ঠিকাদারি প্রথা বিলোপ করে স্থানীয় কৃষকদের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করছে সরকার। তবে কৃষকদের বদলে মধ্যস্বত্বভোগীরা পিআইসি বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ ওঠে প্রতিবছরই। এবারও একাধিক লিখিত অভিযোগ করেছিলেন কৃষকরা।

সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলার ছোট-বড় ৫২টি হাওরের ৭৪৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সংস্কার ও ক্লোজার নির্মাণ করতে এক হাজার ৭৮টি প্রকল্প নেওয়া হয়।
পাউবোর উপজেলা সেকশন অফিসার এবং মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিসের ২৬ জন সার্ভেয়ার গত নভেম্বরে প্রি-ওয়ার্ক শুরু করেন। প্রি-ওয়ার্কে তাঁরা প্রায় ২০৪ কোটি টাকার বরাদ্দ চান।

কৃষক ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এসওরা সার্ভে টিমের প্রধান থাকায় এবং তাঁদের সঙ্গে পিআইসি সিন্ডিকেটের সম্পর্ক থাকায় প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ার তৎপরতা দেখা যায়। তাঁরা পিআইসি চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে দুই থেকে তিন গুণ বরাদ্দ বাড়িয়ে দেন।

গত ১৫ এপ্রিল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের একটি বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী হাওরের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে বলে জানান।

পোস্ট-ওয়ার্কের জন্য ঢাকার দুজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে তদারকি করার দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাঁরা কেউ মাঠে আসেননি।
উপজেলা থেকে পোস্ট-ওয়ার্ক রিপোর্ট আসার পর জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক যাচাই করার জন্য গত ৭ জুন সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন। পাউবোর জেলা অফিসে উপজেলা থেকে পাঠানো পোস্ট-ওয়ার্কে নানা অসংগতি দেখে তা সংশোধন করে পাঠানোর জন্য মৌখিক আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে শাল্লা উপজেলার এসও আব্দুুল কাইয়ুমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি করা হয়েছে। তবে গত শনিবারও তাঁকে বিল-ভাউচার প্রস্তুত করতে দেখা গেছে।

একটি অডিও রেকর্ডে শাল্লা উপজেলার সেকশন অফিসার আব্দুল কাইয়ুমকে এক প্রকল্পের সভাপতিকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি তিন ফুটের বান করছেন। বস্তা কম দিছেন। এর পরও বাড়াইয়া দিতাছি।’

তখন ওই সভাপতি প্রশ্ন করেন, ‘স্যার, আপনি বলছেন ছয় লাখ বাড়াইয়া দিবেন। আপনাকে চৈতমাইয়া দিনে ৫০ হাজার টাকা নগদ দিছি। আর কত দিব বলেন।’

তখন এসও আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘তিন ভাগের এক ভাগ দিবেন। ১০ টাকা বাড়াইলে তিন টাকা দিবেন। আপনার সঙ্গে কথা এইটা। যাবার আগে অফিসের খরচ ও রিভাইসড বাবদ টাকা দিয়ে যান।’

এ বিষয়ে জানতে এসও আব্দুল কাইয়ুমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি তা ধরেননি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহসভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিআইসি দিয়ে টাকা নেওয়া হয়, এটা হাওরে ওপেন সিক্রেট। যারা আগাম ঘুষ দিতে পারে তাদের অক্ষত, অল্প ক্ষতিগ্রস্ত ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পেও বিপুল বরাদ্দ দেয়। আবার পোস্ট-ওয়ার্কের সময়ও তাদের জিম্মি করে আরেক দফা নগদ টাকা নেওয়া হয়। বিনিময়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় করা হয়।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেনরায় বলেন, ‘আমরা একাধিকবার পোস্ট-ওয়ার্ক, প্রি-ওয়ার্ক ও কাজের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। প্রতিবাদ সমাবেশ করেছি। প্রি-ওয়ার্কের সময় যে অভিযুক্তদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছিল, পোস্ট-ওয়ার্কেও তাঁদের দিয়েই মনগড়া রিপোর্ট করানো হয়েছে। এতে সরকারের অন্তত ৫০ কোটি টাকার বেশি অপচয় হবে।’

হাওরের বাঁধ নির্মাণ জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মকসুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি পোস্ট-ওয়ার্ক যাচাই করার জন্য কমিটি করে দিয়েছি। এখন কোন পর্যায়ে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলতে পারবেন।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা গত মাসে উপজেলা থেকে পোস্ট-ওয়ার্ক পেয়েছি। এখন জেলা কমিটি যাচাই-বাছাই করবে। তবে এখনো কমিটি বসতে পারেনি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/10/1297203