২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪১

বোরো উৎপাদন হোঁচট খেল

হাওরে ফসলহানি

কৃষকদের মধ্যে একটি দেহাতি কথা চালু রয়েছে, 'বোরো পালায়, তিল ছালায়'। অর্থাৎ বোরো ধান যতক্ষণ জমি থেকে কেটে পালা দেওয়া (এক জায়গায় জড়ো করা) না হচ্ছে, ততক্ষণ ভরসা পান না কৃষকরা। আর তিল ছালায় (বস্তা) ভরার পরই নিশ্চিত বোধ করেন কৃষকরা। কারণ এসব ফসল ঘরে আসে চৈত্রের দাবদাহ বা বৈশাখের বৃষ্টি ও কালবৈশাখীর সময়। এবারে হাওরে বিপর্যয়ের ঘটনা এই নির্মম সত্যই কৃষকদের মনে করে দিয়েছে। তবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বোরো ধানের বড় ধরনের ক্ষতি হলেও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নেই।

ইতিমধ্যে আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে দেশের হাওর অঞ্চল। ১৪২টি হাওরে দুই লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছিল। এসব জমি থেকে ৯ লাখ ৩০ হাজার

টন বোরো ধান উৎপাদন হবে বলে আশা ছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই)। কিন্তু কৃষকরা বা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এখন আশাহত। এদিকে বুধবার থেকে চলনবিলেও বন্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় পাকা ধান ডুবে গেছে। কিছু এলাকায় কৃষকের কাটা ধান জমিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ব্লাস্ট (এক ধরনের ছত্রাক) আক্রমণের ফলে ধানের শীষে দানা নেই। সব

মিলিয়ে এ বছর বোরো থেকে লক্ষ্য অনুযায়ী উৎপাদন হবে না। ইতিমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধরেই নিয়েছে, এ বছর বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৫ লাখ টন কম হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষ্যের তুলনায় উৎপাদন ঘাটতি হবে ১০ লাখ টনের বেশি। সঠিক হিসাব পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।

চলতি অর্থবছরে সারাদেশের ৪৫টি জেলায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এসব জমি থেকে এক কোটি ৯১ লাখ টন ধান উৎপাদন হবে বলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে। যদিও বোরো মৌসুমের বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় উৎপাদন আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক প্রতিবেদনে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি ধান উৎপাদন হবে বলে প্রাক্কলন করেছিল। কারণ, স্বাভাবিক বৃষ্টির পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি থাকায় ফলন বেশি হয়। কিন্তু মৌসুমের শেষে এসে অতিবৃষ্টি ও হাওরে বিপর্যয়ের ফলে ধান উৎপাদনের এ পূর্বাভাসও ঠিক থাকবে না।

কৃষিবিদরা বলছেন, এ বছর চৈত্র মাস থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রীষ্মের এই মাসে রাতে শীতও ছিল, যা ধানে দানা তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর পরের মাস বৈশাখ বা এপ্রিলজুড়েই চলছে অতিবৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাভাবিকের তুলনায় ১১৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এপ্রিলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ চার হাজার ৫৩ মিলিমিটার। মাসটির ২৩ দিনেই আট হাজার ৯০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা গত ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ বৃষ্টিপাতকে ব্যতিক্রম ও অস্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস। সাগরে লঘুচাপ বেশি থাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক চৈতন্য কুমার দাস সমকালকে বলেন, হাওর অঞ্চলে দুই লাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ফলে ওই এলাকা থেকে যে পরিমাণ ধান পাওয়া যেত, তা পাওয়া যাবে না। আবার কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারণে ধান তলিয়ে গেছে। সেখানে কিছু ক্ষতি হতে পারে। তবে এ বছর সার্বিক ফলন ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। এখন মেঘ চলে যাচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহ বৃষ্টি না হলে ক্ষতি বিশেষ হবে না।

দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রধানত বোরো উৎপাদন বেশি হয়। বিশেষ করে নওগাঁ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর অঞ্চলে বোরো ফসলের চাষ বেশি হয়। এসব অঞ্চল এখনও ক্ষতির মুখে পড়েনি। এ জন্য এখনও আশা দেখছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের মতে এ অঞ্চলে বোরোর কোনো ক্ষতি না হলে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।

ব্র্যাকের কৃষি বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ইতিমধ্যে হাওর অঞ্চলের প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ধানের হিসাবে প্রায় ১২ লাখ টন। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত যা ছিল তাতে উৎপাদন ভালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এপ্রিলে এসে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়া এবং মার্চে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। রাতের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম হলে ধানে চিটা হয়। সামগ্রিকভাবে বোরোর উৎপাদন ভালো হবে বলেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তা কিছুটা হোঁচট খেলো। এখন ফসল সংগ্রহ করা সমস্যাসংকুল হয়ে পড়েছে। যদি আবহাওয়া ভালো হয়, তাহলে ক্ষতি কম হবে। তবে চালের মান খারাপ হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, হাওরে বন্যার জন্য ৬ থেকে ৭ শতাংশ উৎপাদন কম হবে। আর অতিবৃষ্টির কারণে সারাদেশে আরও ২ থেকে ৩ শতাংশ উৎপাদন কম হবে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়েছে। এসব ধানের অধিকাংশ মাড়াই করা হয়নি। এতে চালের মান খারাপ হবে। আবার বীজ ধানের মানও খারাপ হতে পারে।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, দেশে আউশ, আমন, বোরো_ এই তিন মৌসুমে ধান উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বোরোর মাধ্যমে অপর দুই মৌসুমের সমান ধান উৎপাদন হয়। এখন বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা আমন ও আউশে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে আমন-আউশ ভালো হলে ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবে সবই নির্ভর করবে প্রকৃতির ওপর। 

http://bangla.samakal.net/2017/04/27/288384#sthash.xSbLpmS9.dpuf