১০ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১০:৪৭

৩ চক্রে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার

চাল, ডাল, পিয়াজ, চিনি, আটা, নুন, ভোজ্য তেল, মাছ, সবজি ও মুরগি- এসব পণ্য নিয়ে যেন চলছে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। আবার কোনো পণ্যের দাম প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। মানুষ যা আয় করছে সিংহভাগই শেষ হচ্ছে বাজার করতে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়ে। কিন্তু পরে কমলে দেশের বাজারে আর কমে না। মূলত দেশের ভোগ্যপণ্যের দাম ওঠানামা করে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, বড় ব্যবসায়ী ও অসাধু পাইকার সিন্ডিকেট চক্রের ইচ্ছায় বলে মনে করেন অনেকেই। ভোজ্য তেল, চিনি, আদা-ময়দা থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যই এরাই উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে। তাদের কাছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেন অসহায়।

জানা গেছে, সরকার কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে কেনাবেচা হয় না। নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত নিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।
বিজ্ঞাপন

কখনো কখনো চলে নামমাত্র অভিযান। তাতে হাতেগোনা কিছু চুনোপুটি ধরা পড়ে। আর বরাবরের মতোই আড়ালেই থেকে যায় রাঘববোয়ালদের ক্ষমতাশালী সেসব সিন্ডিকেট।

এদিকে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব নিয়ে জাতীয় সংসদে কয়েক দিন আগে তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনিও স্বীকার করেন, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের কিছু বললে বাজার সংকট সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ বাজারে সিন্ডিকেট আছে- এ তথ্য এটা এখন ওপেন সিক্রেট।

ওদিকে আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নাভিশ্বাস। খোদ শিল্প প্রতিমন্ত্রীও কিছুদিন আগে ‘মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ, বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।

সংশ্লিষ্টদের মতে, অভ্যন্তরীণভাবে বাজারে শৃঙ্খলা না থাকা এবং সিন্ডিকেটের অতি মুনাফা করার প্রবণতায় লাগামহীন হচ্ছে বাজার। দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো পণ্যের দাম কমলেও দেশে উল্টো বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের তুলনায় কমেছে সামান্য। আবার বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় দেশে বেড়েছে অনেক বেশি। ওই প্রতিবেদন মতে, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি কমেছে ৪৪ শতাংশ। অথচ দেশে কমেছে বোতলজাত সয়াবিনে ০.২৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিনে ২.১৭ শতাংশ। যদিও ভোজ্য তেলের মজুত চাহিদার তুলনায় ২ লাখ ৩০ হাজার টন বেশি। এ ছাড়া আদার দাম বিশ্ববাজারে ১৭২ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ২২২.২২ শতাংশ। অবশ্য আদার ঘাটতি ৭৭ হাজার টন।

গত মে মাসে হঠাৎ করে পিয়াজের দাম বেড়ে গেলে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পিয়াজ উৎপন্ন হয়েছে, যথেষ্ট মজুত আছে। কিন্তু আমদানি বন্ধ থাকার দোহাই দিয়ে, সরবরাহ সংকট দেখিয়ে তখন পিয়াজের বাজার অস্থির করে তোলা হয়েছিল। পরে আমদানির ঘোষণা আসতেই দাম অনেকটা কমে যায়। সম্প্রতি কাঁচামরিচের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে।

জাতীয় টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন মতে, এক বছরে পিয়াজের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৬৩ শতাংশ কমলেও দেশে বেড়েছে ৯৩.৩৩ শতাংশ। অথচ দেশে পিয়াজের মজুত চাহিদার তুলনায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন বেশি।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার জন্য কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণই দায়ী। সরকারও এদের কাছে অসহায়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ভোজ্য তেলের ব্যবসায় সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকে গ্রুপ, এসিআই, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। চিনি ব্যবসায় সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম গ্রুপ। আটার ব্যবসায় সিটি, মেঘনা, টিকে, এসিআই, বসুন্ধরা, এস আলম, নাবিল গ্রুপসহ চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

আমদানিকারকদের দাবি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার সংকটে সময়মতো ঋণপত্র খুলতে না পারায় কিছু পণ্যের ঘাটতি আছে। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৩৪-৩৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ কমলেও দেশে আরও ৮ শতাংশ ঘাটতি থাকছে।

জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ী কখন, কীভাবে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে, সেগুলো আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরছি। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। এটা দুঃখজনক।

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে অপরিশোধিত চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৩৩ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ৫৭.৫৮ শতাংশ। চাহিদার তুলনায় চিনির মজুত ৭২ হাজার টন কম। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম কমেছে ৩৫ শতাংশ। আর দেশে আটার দাম বেড়েছে ১২.৬৩ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ গম আমদানিতে কোনো শুল্কও ধার্য নেই। টাস্কফোর্স সুপারিশে বলেছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে টিসিবি বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সাপ্লাই চেইনের কোন ধাপে বেশি মুনাফা হচ্ছে, তা বের করার জন্য সমীক্ষা করা যেতে পারে।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশের অধিকাংশ মন্ত্রীই ব্যবসায়ী। তারা ভোক্তার স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি দেখছেন। নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারের সংস্থাগুলোর তদারকি জোরদার করা না হলে দাম বাড়তেই থাকবে।

ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, তেল, পিয়াজ, মরিচের পর সবাই যে যার মতো মুনাফা করতে চাচ্ছে। সরকার থেকে বলা হয়েছে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত।’ কৃষি মন্ত্রণালয় বলে ‘এটা বাণিজ্যের দায়িত্ব।’ কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। তার মানে হলো ব্যবসায়ীরা যা পারে মুনাফা করুক। ফলে ব্যবসায়ীরা বুঝে গেছেন, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। কারসাজি করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটার একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই।

এদিকে বোতলজাত প্রতিলিটার ভোজ্য তেলের দাম এখন ১৮৯ টাকা। অথচ এই তেলের দাম কয়েক মাস আগে ছিল ১০০ টাকার মধ্যে। প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৫০ টাকা। ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ছিল চিনির দাম। চালের দামও ক্রেতার নাগালে নেই। ৫০ টাকা কেজির নিচে মিলছে না কোনো চাল। আটা-ময়দার দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। দেশি পিয়াজের কেজি এখনো ৭০ থেকে ৮০ টাকা। মাছের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ডিমের হালিও এখন ৫০ টাকার নিচে নেই।

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দামই বেড়েছে। খোলা আটা এখন প্রতি কেজি ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এক বছর আগে দাম ছিল ৪৫ টাকা। প্যাকেট আটা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এক বছর আগে যা ছিল ৫৪ টাকা। ময়দা এক বছর আগে ছিল ৩০ টাকা, এখন প্রতি কেজি ৭৫ টাকা। দেশি শুকনা মরিচ ৪২০ টাকা, এক বছর আগে যা প্রতি কেজি ৩শ’ টাকায় বিক্রি হয়। দেশি আদা প্রতি কেজি ৪শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগের একই সময়ে যা ছিল ১৪০ টাকা। জিরা প্রতি কেজি এক মাস আগে ছিল ৮৫০ টাকা, এক বছর আগে যা ছিল ৪৫০ টাকা। লবণের কেজি ৪০ টাকা, এক বছর আগে ছিল ৩৬ টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবসময়ই সাধারণ-নিম্নবিত্তের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ধনীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। আয়বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। আয়বৈষম্য বেড়ে গেলে ভোগ বৈষম্যও বেড়ে যায়। তবে পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে ডলার সংকট একমাত্র কারণ হতে পারে না। কারণ অনেক সময় ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=63884