২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪০

ত্রাণ অপ্রতুল, খালি হাতে ফিরছে মানুষ

বিপন্ন হাওর

অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকায় খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল, আটা বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। তবে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ চাল, আটা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন। গতকাল বুধবার সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলায় ভোর থেকে লোকজনকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দুপুরের মধ্যে বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের অনেককে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। তবে স্থানীয় প্রশাসন থেকে আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে ওএমএস কেন্দ্র দ্বিগুণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। গত সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া নেত্রকোনা জেলা সফরের পর সাহায্যের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কিছু ভিজিএফ কার্ড ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় তা একেবারই অপ্রতুল।

এদিকে দরিদ্র মানুষজন লাইনে দাঁড়িয়ে স্বল্প মূল্যে চাল, আটা নিতে পারলেও বিপাকে পড়েছেন সচ্ছল ও মধ্যবিত্তরা। লোকলজ্জার কারণে তারা লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না। তবে নেত্রকোনার সচ্ছল কয়েকজন ব্যক্তিকে মলিন মুখে গতকাল লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল কিনতে দেখা গেছে।

সুনামগঞ্জে ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো অর্ধেক মানুষও চাল নিয়ে ফিরতে পারছেন না। জেলায় এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও জেলে পরিবারের যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে ৭০ হাজারেরও বেশি পরিবার এখনও সাহায্যের তালিকায় আসেনি। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান গতকাল সকালে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি কার্যক্রম দেখতে যান। এ সময় অনেকে তাকে ঘিরে ধরে চাল, আটা না পাওয়ার কথা জানান। তারা বলেন, 'চারদিন ধইরা আয়রাম (আসছি),

প্রতিদিন খালি হাতে ফিইর্রা (ফিরে) যাই স্যার।' বীরগাঁওয়ের রাবেয়া বেগম নামের দরিদ্র কৃষাণী বলেন, '৩টার সময় আইয়া (এসে) উবাইছি (দাঁড়িয়েছি), আমার হমকে (সামনে) যতজন আছে, হেরা (তারা) নেওয়ার পরে, আমি আর পাইমুনি স্যার?' এ সময় অতিরিক্ত ত্রাণ সচিব তাদের জানান, ওএমএস কেন্দ্র দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে তা কার্যকর হবে। এতে সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে।

কেবল দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জেই নয়, পুরো জেলায় একই চিত্র। এক-একটি ওএমএস কেন্দ্রের ডিলারের ৫ কেজি করে ২০০ জনকে চাল দেবার ক্ষমতা থাকলেও লাইনে দাঁড়াচ্ছে ৪০০ থেকে এক হাজার মানুষ।

শান্তিগঞ্জের ডিলার মুজিবুর রহমান বলেন, 'গতকাল আমার কেন্দ্রে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। ভোররাত ৩টা থেকে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। কেউ কেউ তার স্থানে ইট রেখে পেছনের লোককে বলে যাচ্ছেন, এটি থাকল, সিরিয়াল এলে এসে চাল নিয়ে যাব।'

জেলার অনেক স্থানেই যারা কোনোদিন লাইনে দাঁড়াননি তারাও ওএমএসের চালের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। এরকমই একজন কালা মিয়া। তিনি বলেন, 'লজ্জা ছেড়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি, অনেকে আমার দিকে চেয়ে থেকেছে, নিজের কষ্ট হয়েছে, কিন্তু উপায় নেই, চাল নিলেই খাওয়া, না হয় না খেয়ে থাকতে হবে।'

ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর বাজারে একজন ডিলারের মাধ্যমে ওএমএসের কার্যক্রম পরিচালনা করায় শুধু মধ্যনগর বাজার ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষজন ঘুরেফিরে এই সুবিধা পাচ্ছেন। দূরে অবস্থিত আরও তিনটি ইউনিয়নের মানুষজন সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একইভাবে উপজেলা সদরে দু'জন ডিলারের মাধ্যমে চাল, আটা বিক্রি করলেও ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতে দরিদ্র জনগণ সেই সুবিধা পাচ্ছেন না।

ধর্মপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের মকবুল মিয়া ও নোয়াবন গ্রামের শরিফা খাতুন জানান, তারা প্রতিদিন ডিলারের দোকানের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের সিরিয়াল আসার আগেই চাল শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা একদিনও চাল নিতে পারেননি।

উপজেলা সদরে নিযুক্ত ওএসএমের ডিলার শওকত আলী গতকাল বিকেলে বলেন, 'আজ (বুধবার) চাল-আটা দুটিই দিয়েছি। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় মানুষজনকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।'

সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন থেকে ধর্মপাশার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। ওই ইউনিয়ন থেকে ধর্মপাশায় পেঁৗছাতে এক ব্যক্তির আসা-যাওয়ায় প্রায় ২০০ টাকা খরচ হয়। পাঁচ কেজি চালের জন্য এতো টাকা খরচ করে গরিব মানুষের পক্ষে উপজেলা সদরে আসা অমূলক বলে জানালেন সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ। একই বক্তব্য জয়শ্রী ইউপি চেয়ারম্যান সঞ্জয় রায় চৌধুরীর।

নেত্রকোনা জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে চাল ও আটা বিক্রির জন্য নতুন ডিলার নিয়োগ করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে তারা বিক্রি কার্যক্রম শুরু করবেন।

মোহনগঞ্জের মাঘান গ্রামের ওএমএসে চাল নিতে আসা জোলেখা আক্তার খাতুন বলেন 'সারাটা দিন বইসা থাইক্যাও চাউল পাই নাই। ডিলাররা পরিচিত লোকজন দেখেই চাউল দেয়। আমরার গরিবরার কোনো দাম নাই। আমাদের কথা কেউ শুনে না।'

খালিয়াজুরী গ্রামের সচ্ছল গৃহস্থ শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, 'আমার এমনিতে ৮০০ থেকে এক হাজার মণ ধান হয়। এইবারের বন্যায় আমার সব নিয়া গেছে। সারাদিন দাঁড়াইয়া থাক্যা ৫ কেজি চাউল আনছি।'

খালিয়াজুরী উপজেলায় ওএমএস কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা ট্যাগ অফিসার রফিকুল ইসলাম জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। তাই প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।

খালিয়াজুরী সদর ইউপি চেয়ারম্যান সানোয়ারুজ্জামান যোসেফ বলেন, উপজেলা সদরে তিনজন ডিলারের মাধ্যমে ওএমএসের চাল দেওয়া হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বাকি পাঁচটি ইউনিয়নে ডিলার নিয়োগ করার দাবি জানান তিনি।

খালিয়াজুরী ইউএনও মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওএমএসের চাল ও আটার বরাদ্দ বাড়াতে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলার নিয়োগ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

http://bangla.samakal.net/2017/04/27/288372#sthash.EZBMbBuR.dpuf