১০ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১০:৩৫

চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু আক্রান্ত

সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি ৮৩৬ : মৃত্যু ৬

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। প্রতিদিন যেমন রোগী বাড়ছে তেমনি হাসপাতালেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। কমে আসছে সেবা দেয়ার সক্ষমতা ও সিট ক্যাপাসিটি। সাধারণত মেডিসিন ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু চিকিৎসা হয়ে থাকে। এই ওয়ার্ডের অন্য ধরনের রোগীরা কর্তৃপক্ষের মনোযোগ কম পাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগী বেশি আসায় চিকিৎসক, ওষুধ এবং অন্যান্য উপকরণ ডেঙ্গু ওয়ার্ডে বেশি যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে ডেঙ্গুর উপর মিডিয়ার ফোকাস বেশি। ফলে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ডাক্তার নার্সদের তৎপরতাও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ৭৫০ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছে। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৯৬৮ জন।

গতকাল সকাল ৮টার পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৮৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জিন্সি অ্যান্ড কনট্রোল রুমের ডিপিএম ডা: মো: জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন। একই সময়ে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি ডেঙ্গু মৌসুমে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বীকার করেছেন যে, সামনে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরো বাড়বে।

বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক জানিয়েছেন, ‘এডিস মশার উৎপাদন স্থানগুলো ধ্বংস করে দিতে পারলে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমে যাবে অনেকাংশে। ফগিং করে পরিণত মশা মারার সাথে সাথে পানি রয়েছে এমন প্রত্যেকটা স্থানে লার্ভিসাইডিং করতে হবে দৈনিক। ডেঙ্গুর এই সময়টায় সিটি করপোরেশনকে একটু বেশি উদ্যোগী অভিযান পরিচালনা করলে মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। এখন উচিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এ সংক্রান্ত সব কর্মীকে দৈনিক মাঠে নামানো।’

গত ২৪ ঘণ্টায় যে ক’জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এর মধ্যে ঢাকা শহরের ৫৩ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫১৬ জন এবং দেশের অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বাকি ৩২০ জন। চলতি জুলাই মাসের ৯ দিনেই ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যু দিক থেকে জুন মাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেছে। জুলাইয়ের ৯ দিনে মোট ৪ হাজার ৯৭৬ অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে, আর সারা দেশে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে জুনের ৩০ দিনে সারা দেশে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং মারা গেছে ৩৪ জন। জুলাই মাসের আরো ২২ দিন সামনে রয়ে গেছে। এই ২২ দিনে বর্তমানের চেয়ে আরো কমপক্ষে ৩ গুণ অর্থাৎ ১৫ হাজার মানুষ ভর্তি হতে পারে বলে মুগদা হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, ডেঙ্গু মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। সামনে দিনগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসকরাই জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ঢাকা প্রতিটি মানুষই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এই মুহূর্তে ঢাকায় ডেঙ্গু বেশি হলেও একটা সময় তার দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়তে পারে।

মুগদা হাসপাতালের ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, মানুষ হাসপাতালে আসছে মুমূর্ষু হয়ে। ফলে সুস্থ হতে যেমন দেরি হচ্ছে তেমনি চিকিৎসায় খরচও হচ্ছে বেশি। তিনি বলেন, জ্বর হলেই এখন উচিত ডেঙ্গু হয়েছে কিনা পরীক্ষা করা। জানতে পারলে শুরুতেই চিকিৎসা নিয়ে রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার আগেই সুস্থ হওয়া সম্ভব। এতে রোগী, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই কম ভোগিন্ত পোহাতে হয়। এখন ৫০০ টাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে ৩০০ টাকায় করা যাচ্ছে। তাছাড়া শুরু থেকেই প্রচুর জলীয় দ্রবণ অর্থাৎ ভিটামিন সি জাতীয় পানি, খাবার স্যালাইন খেয়ে গেলে ডেঙ্গু জীবাণু রোগীকে খুব বেশি কাহিল করতে পারে না। হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে কেবল ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ফেললেই সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যু রোধ করা যেতে পারে। রোগী ও অভিভাবকরা সচেতন হলে হাসপাতালের চাপ কমানো যেতে পারে।

ঢাকার সর্বত্র ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস জাতীয় মশার লার্ভার অস্তিত্ব রয়েছে। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, ঢাকাবাসী নিজেরাই আবিস্কার করছেন তাদের বাড়িঘরের আশপাশে মশার লার্ভার অস্তিত্ব। তারাও সেগুলো নিজেরা বিভিন্নভাবে ধ্বংস করার চেষ্টাও করছেন।

চাঁদপুরে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর প্রকোপ। গত সাত দিনে আড়াই শ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩২ রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। এদের মধ্যে বর্তমানে বেশ কিছু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ডে ও চতুর্থ তলার মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ দিকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি এই হাসপাতালটিতে পুরুষ ওয়ার্ড এবং মহিলা ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই ইউনিটগুলোতে মশারি টাঙিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

খবর নিয়ে জানা গেছে চাঁদপুর আড়াই শ’ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি জেনারেল হাসপাতালে এই চলতি মাসের ১ জুলাই থেকে ৮ জুলাই শনিবার পর্যন্ত ৮ দিনেই ৩২ জন নারী পুরুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ওয়ার্ড ২৫ জন এবং মহিলা ওয়ার্ডে সর্বমোট সাতজন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ড ও মহিলা ওয়ার্ডের ডেঙ্গু ইউনিটে বর্তমানে বেশ কিছু ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এ ছাড়া এপ্রিল মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত গত তিন মাসে হাসপাতালে সর্বমোট ৮০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর এমন তথ্য জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা নুরুদ্দিন মো: জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, গত তিন মাসে এপ্রিল মাসে চারজন, মে মাসে আটজন এবং

জুন ৬৮ জন এবং চলতি মাসের ৮ তারিখ শনিবার পর্যন্ত ৩২ জন। সর্বমোট ১১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন।

হাসপাতালে ডিউটিরত নার্সরা জানান, ভর্তিকৃত রোগীরা গত কয়েক দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তাদের রক্ত পরীক্ষা করলে তারা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের বিষয়টি শনাক্ত হয়। এ বিষয়ে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: এ কে এম মাহাবুবুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্ষা মৌসুমে সাধারণ মশা ও এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। যার ফলে ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়া রোগ ছড়ায়।

শরণখোলায় ডেঙ্গুজ্বরে শিশুর মৃত্যু
শরণখোলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, শরণখোলায় গতকাল সকালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে কৌশিক নন্দী (৪) নামে একটি শিশু মারা গেছে। শিশুটি উপজেলার ধানসাগর গ্রামের সমির নন্দীর ছেলে।
মৃত শিশুর পিতা জানান, গত শুক্রবার রাতে তার শিশু পুত্র কৌশিক জ্বরে আক্রান্ত হয়। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা: তহিদুল ইসলামের কাছে নিলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে চিকিৎসক জানান, তার ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত। শিশুটির অবস্থা খারাপ হলে রোববার সকালে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে নিলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন বলে শিশুর পিতা সমির নন্দী জানিয়েছেন।

শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: প্রিয় গোপাল বিশ্বাস বলেন, শরণখোলায় প্রথম এই শিশুটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ইতোমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে বলে ড. প্রিয় গোপাল বিশ্বাস জানিয়েছেন।

সাতক্ষীরা জেলায় ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরায় গতকাল পর্যন্ত মোট ১৯ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ও কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন ভর্তি রয়েছে। বাকিরা নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার ও তথ্য কর্মকর্তা ডা: জয়ন্ত কুমার সরকার জানান, সাতক্ষীরায় ৯ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৯ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে জেলায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখনো পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি।
সিভিল সার্জন ডা: সবিজুর রহমান জানান, সারা দেশের মতো সাতক্ষীরায়ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। জেলায় এ পর্যন্ত ১৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/761110/