১০ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১০:২৭

তেতো ঝালে ঈদ আনন্দ

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

মাত্র ক’দিন আগে শেষ হলো ঈদুল আজহা। সারা দেশের মুসলিম জনপদে এ উপলক্ষে প্রস্তুতির আয়োজন বহুমাত্রিক। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন। এক দিকে খামার ব্যবসায়ীরা, যারা সারা বছর ধরে গরু, ছাগল, মহিষকে অপত্য স্নেহে লালন করেন। অপর দিকে যারা কোরবানি দেবেন। মাঝখানে দালাল-ফটকাবাজ এবং বিভিন্ন হাটের ইজারাদার। রয়েছেন গরু পরিবহনের কাজে ব্যস্ত পরিবহন মালিক এবং শ্রমিক। আরো রয়েছেন এক বা দু’দিনের জন্য কসাই হওয়া বিপুল জনশক্তি, রয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ী, চামড়া সংরক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় লবণ ব্যবসায়ী; সব মিলিয়ে বিশাল আর্থিক লেনদেনের এক বিপুল আয়োজন।

সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই অনুভূতি নিয়ে পালিত হয় ঈদুল আজহা। কোরবানির শিক্ষা-ত্যাগের মহিমায় অভিষিক্ত হওয়ার চেষ্টায় মেতে ওঠে সমস্ত তৌহিদ বিশ্বাসী জনপদ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যখন ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরীক্ষায় বিশ্বাসীরা নিজেদের সমর্পণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন; তখন এ দেশে একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী এটিকে শোষণের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। কোরবানির জন্য পশু ছাড়াও যেসব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের প্রয়োজন পড়ে, হঠাৎ করেই দেখা যায় সেগুলো বাজার থেকে উধাও। অনেক হম্বি তম্বি করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে, তারপরেই সব নীরব। সাধারণ জনগণ নিজেরাই কোরবানি হয়ে যায় এসব নরপিশাচরূপী ব্যবসায়ী হিংস্র হায়েনাদের লোভের কাছে। না হলে প্রতি বছরই রমজানের ঈদ, কোরবানির ঈদের পূর্বমুহূর্তে লবণ তেল চিনি পেঁয়াজ আদা মরিচের দাম রাতারাতি কয়েক শ’ গুণ বেড়ে যায় কিভাবে? কর্তৃপক্ষের হুঁশিয়ারি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অকার্যকর তদারকি শুধু হাসির খোরাকেই পরিণত হয় না; জন্ম দেয় নতুন কথামালার। সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। জনগণ সুখেই আছে, বেহেশতি আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এ ধরনের আপ্তবাক্য আউড়িয়ে আর যা-ই হোক, মূল্যস্ফীতির আগুন নেভানো যায় না। যায় না লোলুপ বেনিয়াদের হিংস্র থাবা থেকে অসহায় জনগণকে বাঁচানো। বারবার এ ধরনের ঘটার পুনরাবৃত্তি প্রশাসনের অসহায়ত্বই কেবল প্রকট করে তোলে।

এবারের ঈদুল আজহার কথাই ধরি। ঈদের আগ মুহূর্তে হঠাৎ পেঁয়াজের ঝাঁজের উল্লম্ফন তাও একেবারে পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে, যা এর আগে কখনোই হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা নিলো দাম কমাতে। একইভাবে চিনি ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়ানোর আবদার জানিয়ে বসলেন। শুধু বসলেনই না; বাজারে তাদের প্রস্তাবিত মূল্যে বিক্রি শুরু করে দিলেন সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা না করে। ঈদের দু’দিন আগে যে কাঁচামরিচ ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি, তা হঠাৎ করেই ঈদের এক দিন আগেই তরতর করে হাজার টাকা কেজিতে পৌঁছাল। তাও আবার মরিচের মৌসুমে। আবার আমদানির তোড়জোড়। আদা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি। গরমমসলার গরমে কাছে ভেড়া দায়। অপর দিকে গরু খামারিদের অনেকেরই মাথায় হাত। গরু পালতে গিয়ে তাদের যে খরচ হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা পোষাতে পারেননি গরু বিক্রি করে। বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুকেই আমদানিমুখী করার যে কৃতিত্ব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগার ওপর তা দেখবে কে? এর কিছু দিন আগে ডিম নিয়ে একই খেলা হয়েছে। পকেট ফাঁকা হয়েছে সাধারণ জনগণের। লাভের টাকায় উদরস্ফীত হয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের। লাভবান হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশে বাম্পার ফলন হয়েছে আলুর। সংরক্ষণাগারেও রয়েছে প্রচুর আলু। সরবরাহে নেই কোনো ঘাটতি। অথচ আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, সীমিত আয়ের চাকরিজীবী যাবে কোথায়? দ্রব্যমূল্যের এ অবস্থা নিয়ে ব্যবসায়ীদের কারসাজি প্রসঙ্গে মাননীয় সংসদ সদস্যরাও সংসদে কথা বলেছেন; দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মনে হচ্ছে, এ দেশের কৃষি শিল্প বাণিজ্য সবকিছুকে আমদানিনির্ভর করে নিজস্ব অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার নিরলস চেষ্টায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কাজ করছে। তাদের ক্ষমতার ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত যে, প্রশাসনও তাদের কাছে অসহায়। নইলে সারা পৃথিবীতে যখন সব দ্রব্যমূল্য কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরে এসেছে বাংলাদেশে তা হচ্ছে না কেন? সারা পৃথিবীই তো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এটা করতে পেরেছে; আমরা পারছি না কেন এ প্রশ্ন জাগা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

ফিরে আসি গোড়ার কথায়। এবারের ঈদুল আজহা কেমন কেটেছে- গ্রাম থেকে ফেরার পর পরিচিতজন এই প্রশ্নই করেছেন এবং করছেন। যুৎসই জবাব দিতে পারিনি। একে তো একদিকে আল্লাহর রহমতে বৃষ্টির প্রাবল্য আনন্দকে মিশ্রতা দান করেছে বহু বছর পরে; চিনির তেতো স্বাদ, কাঁচামরিচের অগ্নিসম ঝাল, আদা এবং গরমমসলা কিনতে গিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থা, সবমিলিয়ে এবারের কোরবানির ঈদ ছিল টক মিষ্টি ঝালের পরিবর্তে তেতো আর ঝালের আধিক্যে মাখানো এক অনবদ্য অনুভূতি। ঈদের মৌলিক আনন্দ সেখানে মাথা কুটে মরেছে।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/760981