২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৮

কবি নজরুল কলেজে ভর্তিবাণিজ্য

পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে ভর্তি রসিদ জালিয়াতি করে চলতি বছর শতাধিক শিক্ষার্থীর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কতিপয় ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের দেওয়া ফি কলেজের তহবিলে জমা না হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে টাকা চাইছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতারা এর দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এ জন্য কলেজ প্রশাসনকেই দায়ী করছেন। বিষয়টি তদন্তে কলেজ প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে।

ঘটনাটি মার্চের শুরুতে। চলতি বছর ভর্তি হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের স্নাতক শ্রেণিতে সর্বনিম্ন তিন হাজার ২০২ টাকা এবং স্নাতকোত্তরে সর্বনিম্ন তিন হাজার ৮০০ টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু ১১৬ শিক্ষার্থীর ভর্তির সময় দেওয়া ফি জমা হয়নি কলেজ তহবিলে, এর পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। কলেজের ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্সে (প্রিলিমিনারি) ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থী সমকালকে জানান, তিনি পাঁচ হাজার

৭০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু কয়েকদিন ধরে কর্তৃপক্ষ তাকে ফোন দেয় ভর্তির টাকা জমা দিতে। তার প্রশ্ন, 'আমি আবার কেন টাকা জমা দেব ভাই? আমি একবার টাকা জমা দিয়েছি। আর দিতে পারব না।' কেউ জালিয়াতি করে থাকলে তার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে।

অর্থনীতি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'ভর্তির সময় আমরা নিজের হাতে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারি না। ব্যাংকের ভেতরে স্যাররা ছাত্রলীগের নেতাদের বসিয়ে রাখেন। তারাই টাকা নেন, তারাই রসিদ দেন। ব্যাংকের সিল-স্বাক্ষরসহ টাকা জমার রসিদ জমা দিয়ে আমরা ভর্তি হয়েছি। এখন রসিদ জালিয়াতি হলে তার দায়িত্ব কেন আমরা নেব?'

শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে দু'জন নেতা সব সময় ব্যাংকের মধ্যে বসে থাকেন। তাদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়। সব সময়ই নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে ২০০-৩০০ টাকা বেশি দিতে হয় তাদের। তবে রসিদ জালিয়াতির ঘটনা এবারই প্রথম। কলেজের এক কর্মকর্তা বলেন, 'তার জানামতে, এ বছর ডিগ্রির প্রায় ৭৭ জন ও প্রিলিমিনারি-মাস্টার্সের প্রায় ৩৯ জনের টাকা ছাত্রলীগ নেতারা ব্যাংকে জমা না দিয়েই রসিদ দিয়েছেন।'

তবে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তা বেশি নয় বলে দাবি করেন কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুক্তি রানী সাহা। সংখ্যা না জানিয়ে তিনি সমকালকে বলেন, 'এই সমস্যা যাদের হয়েছে, তাদের আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, সমাধান করে দেব।' তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও তিনি স্বীকার করেন। তবে তদন্ত কমিটির সদস্য অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বদিউল আলম কিছু বলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান মোহন বলেন, 'এমন হতে পারে, ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।' ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাওলাদার বলেন, 'ভর্তির টাকা জালিয়াতির সঙ্গে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নন। এটা তো প্রশাসনের বিষয়। ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এসব প্রচার চালানো হচ্ছে। তবে কেউ ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে এ ধরনের কাজ করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো নতুন বিষয় নয়। আগের কমিটির নেতারাও একইভাবে বাণিজ্য করেছেন। এ কলেজে গত বছর এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ১৭০ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৩৫০, ব্যবসায় শিক্ষায় ৪৫০ ও মানবিকে ৩৭০ জন। বোর্ডের মেধা তালিকা অনুযায়ী ২৭ জুন প্রথম দফা ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়। এর পর শুরু হয় মেধা তালিকায় অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম। একই সঙ্গে কলেজ প্রশাসনের সামনেই চলে ছাত্রলীগ নেতাদের ভর্তি বাণিজ্য।

ছাত্রলীগের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন,'ওয়েটিং লিস্টের সিরিয়াল পেছনে থাকায় বড় ভাইরা তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন।' কলেজ শাখা ছাত্রলীগের এক কর্মী জানান, উচ্চমাধ্যমিকের অপেক্ষমাণ প্রায় ৪৫০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। গতবার এই ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মামুন-উর-রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক রাকিব হাসানের বিরুদ্ধে। ভর্তি ছাড়াও ভর্তির ফরম বিক্রির সঙ্গে অতিরিক্ত ১০০ টাকা করে আদায় করারও অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর ওই কমিটি বিলুপ্ত করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ। গত বছরের ২১ অক্টোবর পুলিশ অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবাসহ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মামুনুর রশীদকে গ্রেফতার করে। তিনি কিছুদিন জেলও খাটেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ওই সময় তাকে বহিষ্কার করে।

অন্তহীন সমস্যা :সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে তিন একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ কলেজেই চলছে ইসলামী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। একই ভবনে ক্লাস হচ্ছে কলেজ ও স্কুলের। কয়েকজন শিক্ষক জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ক্রাশ প্রোগ্রামের' কারণে এমনিতেই সারা বছর পরীক্ষা থাকে। তার ওপর এসএসসি, এইচএসসি, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও হয়। আলাদা পরীক্ষার হল না থাকায় শ্রেণিকক্ষেই পরীক্ষা নিতে হয়। যখন বোর্ডের পরীক্ষা থাকে তখন কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এসব কারণে বছরে কলেজে ক্লাস হয় বড়জোর দু-তিন মাস।

'এ কলেজে ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণি রয়েছে। এসব শ্রেণিতে ২২ হাজার ৩৯৪ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন। অথচ শিক্ষকের পদ রয়েছে মাত্র ৮৫টি। সংযুক্ত শিক্ষক মিলিয়ে এখানে কাজ করছেন ১০৭ জন শিক্ষক। আরও শতাধিক শিক্ষকের দরকার থাকলেও কলেজে এতগুলো পদ নেই।'

শিক্ষকরা জানান, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকট এ কলেজের বড় সমস্যা। তাই সকালে উচ্চ মাধ্যমিক ও দুপুর থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হয়। অনেক পুরনো এ কলেজে আবাসন সংকটও প্রকট। শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রী হলেও এখানে কোনো ছাত্রীনিবাস নেই। ছাত্রীরা আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মেসে থাকেন। স্বাধীনতার পর শ্যামবাজারের মোহনী মোহন দাস লেনের একটি পরিত্যক্ত (অর্পিত সম্পত্তি) বাড়ি লিজ নিয়ে এ কলেজের ছাত্রদের জন্য স্থাপন করা হয় 'শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস'। কিন্তু বাড়িটি নিয়ে এখন মামলা চলছে, একাংশ বেদখল হয়ে গেছে।

এসব বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার সমকালকে বলেন, তিনি দায়িত্বে এসেছেন অল্পদিন হলো। সার্বিক সমস্যা সমাধানে তিনি আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবেন।

 

http://bangla.samakal.net/2017/04/27/288373#sthash.NvVt6ZiJ.dpuf